শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১০

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২০

ডাউনটাউন থেকে ট্রেন ধরি না আর। ক্রিস্তভ আসে। সে শহরের বাইরে একটি বার চালায়। যাওয়ার পথে আমাকে স্টোরে নামিয়ে দেয় আর ফেরার সময় যথারীতি তুলে নেয়। ক্রমশ এই যাতায়াতের পথ বড় মনোরম লাগতে থাকে। যাওয়া আসার পথে দূরগত আশঙ্কাগুলি মনকে চেপে ধরত, শ্বাস রুদ্ধ করত, তারা আর আসে না। ক্রিস্তভ হেসে হেসে পলকে দুর্ভাবনার মেঘগুলি উড়িয়ে দিতে থাকে। চলার পথ অফুরান মনে হয়।

একদিন আমাকে স্টোরে নামিয়ে না দিয়ে ক্রিস্তভ অন্য পথ ধরে। হঠাৎ চমকে উঠে বলি, কোথায় চললে?
ক্রিস্তভ হাসে। বলে, তোমাকে নিয়ে না পালাই যদি তবে লোকে আমাকে ভীরু বলবে।
আমি চঞ্চল হয়ে উঠছি দেখে সে বলে, ভয় পেয়ো না, এখনই নয়।
এখনই নয় মানে?
সে বলে, চলো তোমাকে আমার বারটা দেখিয়ে আনি।
আমি বলি, সে বললেই হতো। স্টোরে জানিয়ে দিতাম।

হাই রোডের ওপর একটি ঝকঝকে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায়। দেখি বড় সাইনবোর্ডে লেখা, `রুবিয়ানা`। ক্রিস্তভ বলে, নামো, এই আমার বার। রুবিয়ানায় প্রবেশ করে দেখি, ছিমছাম বার লাল সোফা আর সুন্দর ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো। দু’একজন লোক সুরাপানে মত্ত। ক্রিস্তভ একটি সোফা দেখিয়ে বলে, বসো। তারপর নিজের হাতে একটা মকটেল বানিয়ে আনে আমার জন্য। ওর গ্লাসে শ্যাম্পেন। ক্রিস্তভ বলে, এই মকটেলের নাম `উন্নাসা`, খুব বিশেষ মানুষদের জন্য। চলো শুরু করো, চিয়ার্স।

আমরা ক্রমশ ঢলি। আমরা মজি। ক্রিস্তভ হাসে। আমি হাসি। মাথা টলমল করে। বোতল ফুরায়। বোতল আসে। এইভাবে বিকেল হয়। একজন দুজন করে বারে জমায়েত হয় সুরাপ্রেমীদের। ক্রিস্তভ বলে, এবার শুরু হবে নাচ। কে দেখাবে নাচ? ক্রিস্তভ বলে, আমার বারে নাচে বেহেস্তের সেরা সুন্দরী। রুবিয়ানায় গৌরব সে, নাম আমারা।

সন্ধ্যা একটু ঘন হতেই পর্দা উন্মোচন করে মঞ্চে অবতীর্ণ হয় আমারা। অপূর্ব সুন্দরী। তেমনই আবেদন। লাল পোশাকে তাকে উর্বশীর মতো লাগে। দারুণ নৃত্য প্রদর্শন করে আসর জমিয়ে দেয় আমারা। ক্রিস্তভ আমার হাত ধরে তোলে। বলে, আমার সাথে নাচো।

আমি হেসে ঢলে যাই তার কাঁধে। তালে তালে নাচি। আমি আর ক্রিস্তভ।  কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়, এই পৃথিবীর অনেক উপরে চলে এসেছি আমরা। নক্ষত্রের কাছাকাছি। তারপর সুরা ফুরায়। গানও। আমারার নাচ সাঙ্গ হয়। ক্রিস্তভ বলে, চলো, তোমায় পৌঁছে দেই।

গাড়িতে উঠে আমি নির্ভার হতে চাই।  ক্রিস্তভের কাঁধে মাথা রাখি। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। চুম্বন করে। আমার ভেতর আমার যা কিছু নিঃশেষিত আমার যত ক্লান্তি আমার যত একাকিত্ব যত কান্না— সে পান করে, যেন সুরা। আমি হালকা হই, হালকা হতে থাকি। আমি ভুলে যাই আমি মারিয়া, আমি জুমেরানের। আমি ভুলে যাই আমার সঙ্গের পুরুষটি ক্রিস্তভ। সে যেন কেবল আমাকে মুক্তি দিতে এসেছে আমার বেদনার দুঃসহ ভার থেকে। সে কে, তাতে কিছুই যায় আসে না। যেন সে ঈশ্বর প্রেরিত, সে প্রেম নয়, অনন্য এক আশ্রয়।

সারাটা পথ সেই ঘোরের ভেতর পার করি। পথও নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে শেষ হয়। আমাকে নামিয়ে ফিরে যায় ক্রিস্তভ। ফিরে যেতে যেতে বলে, আমি ফিরে যেতে আসিনি মারিয়া। ফিরিও না আমায়।

সারারাত বিছানায় শুয়ে ফ্রিতির কথা ভাবি সেদিন। নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়। আমি তো জুমেরানের, কেবল জুমেরানের। তার প্রতি আমার ভালোবাসা সাধারণ ছিল না। তবু কি করে ক্রিস্তভের এত কাছাকাছি এসে পড়লাম! নিজের ওপর ঘৃণা হয়। নিজের ভেতর নিজেকেই দুভাগ হয়ে যেতে দেখি। এক মারিয়া যে এখনো জুমেরানকে ভালোবাসে, তার ফিরে আসার অপেক্ষা করে। আরেক মারিয়া যার আছে জীবনের ক্ষুধা, ক্রিস্তভ যার কাছে অপ্রতিরোধ্য।

সেদিন রাতে ফ্রিতির স্বপ্ন দেখি। দেখি কাঠের ব্রিজের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে জুমেরান। এপারে আমি স্থির দাঁড়িয়ে। জুমেরান হেঁটে আসছে আমার দিকে। কুয়াশার ভেতর সে অস্পষ্ট।  তবু যত সে এগোচ্ছে পথ তত দীর্ঘতর হচ্ছে। কিছুতেই সে পৌঁছতে পারছে না আমার কাছে। অসহায় হয়ে সে ডেকে উঠছে, মারিয়া! মারিয়া...

অথচ আমি নির্বাক। যেন সাড়া দিতেও ভুলে গেছি। সাড়া দিতে না পারার বোবা যন্ত্রণায় আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছে। সেতুর নিচে বয়ে যাচ্ছে ফ্রিতি, কেবল সে সাক্ষী হচ্ছে এই প্রেমের, এই বিচ্ছেদের, এই অসম্ভব যন্ত্রণার... চলবে