শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১৪

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০২০

ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কাজ ছেড়ে একটি অন্য কাজের সন্ধান করি। এরই মধ্যে বেহেস্তে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। সান্দ্রার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সে বলে, স্থানীয় একটি লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানের পদটি খালি আছে। সেখানে আবেদন করে চাকরিটি পেয়ে যাই। হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে নীরব হয়ে থাকা শব্দ তরঙ্গের যে অসীম শক্তি, তা অনেকটা সমুদ্রের তলদেশের মতো। একমাত্র ডুবুরিই তার খোঁজ পায়। ব্যস্ত দিনে পাঠক যখন বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে থেকে ফুট নোট নিতে ব্যস্ত তখন তাদের খেয়াল করি, ওদের চারপাশে একটা অদ্ভুত আলো ঘিরে থাকে। যে মানুষ মন দিয়ে বই পড়ে তাকে দেখতে বড় সুন্দর লাগে।

ওই লাইব্রেরিতেতেই একটি বইয়ের সন্ধান পাই। সুজান মিৎসুর লেখা ‘হুইচ ক্যান নট বি সিন’। যা দেখা যায় না, বরং বলা ভালো যা দেখা দেয় না, সেই সকলের প্রতি আমার একটি ঝোঁক ছিল। হয়তো জীবনে এত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এসেছি বলেই। বইটি সাথে করে নিয়ে বাড়ি ফিরি। সারা রাত উল্টে পাল্টে বইটি পড়ি। বইটির মধ্যে যা ছিল তা কেবল লিখিত শব্দ নয়, তা লেখকের আত্মা। কী অপূর্বভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মানব মনের অস্থিরতা, সংশয়, অনিশ্চয়তা বোধ এবং দ্বন্দ্বগুলিকে। পড়তে পড়তে বুঝতে পারি, কেমন করে প্রতিনিয়ত অন্ধকারে হাতড়ে পথ খুঁজে বেড়াই আমরা। একটি পথের শেষ জুড়ে থাকে আরো অসংখ্য পথের প্রান্ত বিন্দুর সাথে। এক পথ থেকে আরেক পথে ছিটকে যাওয়া, এই তো জীবন। কিন্তু শেষ অবধি সকলেই খুঁজে বেড়ায় এক আলো। বেপথু মানুষ ওই আলোটুকুর জন্যই আরেক জন আলোকিত মানুষকে খুঁজে বেড়ায়।

আমি সুজান মিৎসুর সম্পর্কে খোঁজ নিতে থাকি। জানতে পারি, বেহেস্তই তার জন্মস্থান। প্রত্যেক মাসে তিনি একবার বেহেস্তে আসেন। বেহেস্তের সবথেকে পুরনো চ্যাপেলে বসেন খানিক সময়। বহু মানুষ ঘিরে থাকে তাকে। বহু জিজ্ঞাসা তাদের। জানতে পারি, সুজান একজন মিস্টিক। যা দেখা দেয় না এমন অনেক কিছুই তিনি দেখতে পান এবং বলে দিতে পারেন। মানুষ একটু শান্তির স্পর্শ পাবে বলে তার কাছে ছুটে যায়।

যে মানুষের লেখা এত প্রশান্তি দিতে পারে তিনি নিজেও নিশ্চয়ই শান্তি স্বরূপ হবেন। এমনই আমার বিশ্বাস। কেন জানি না তার দেখা পাওয়ার জন্য আমার মন উতলা হয়ে ওঠে। সান্দ্রার থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সুজান চ্যাপেলে আসবেন ক্রিসমাসের দিন। যেমন করেই হোক ওই দিনই তার দেখা আমার চাই। যেন হাজার শব্দের একটি চিঠি লেখা হচ্ছে আমার ভেতর যা আমি সুজানকে উৎসর্গ করতে চাই। যাকে আমি চিনিও না অথচ শুধু শব্দ বন্ধনে তার সাথে আমার এই নিবিঢ় যোগাযোগ গড়ে উঠেছে, ভেবে আশ্চর্য হই।

ক্রিসমাসের দিন রওনা হই চ্যাপেলের উদ্দেশ্যে। আমার পরনে সাদা গাউন। হাতে সাদা ফুলের গুচ্ছ সুজানের জন্য। জানি না একটি শব্দও তার সামনে উচ্চারণ করতে পারবো কিনা, প্রকাশ করতে পারবো কিনা নিজ মুগ্ধতা। এসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাই চ্যাপেলের গেটে। দূর থেকে দেখি একটি অলিভ গাছের পাশে বসে আছেন এক সৌম্য দর্শন পুরুষ। বয়স পঞ্চাশের কাছে। পরনে চেরি রঙের কোট আর ব্লু ট্রাউজার। তাকে ঘিরে উৎসাহী মানুষের সমাগম। সুজান একটি বই খুলে কিছু পাঠ করছেন। একটা অদ্ভুত নীরব তরঙ্গ যেন আবর্তিত হচ্ছে তাকে ঘিরে। তিনি যা বলছেন সে সকল যেন মিশে যাচ্ছে সেই তরঙ্গের ভেতর।

আমি গিয়ে দাঁড়াই সেই সমাগমের মাঝে। সুজান পাঠ শেষ করে মুখ তুলে তাকান। এক মুহূর্তের জন্য তার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় আমার। আস্তে আস্তে ভিড় একটু কমলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সুজানের মুখে ঈশ্বর সুলভ হাসি। ফুলের গুচ্ছ এগিয়ে দেই তার হাতে। এ কি! আমার চোখে জল কেন আসে? নিজেকে বড় আপ্লুত মনে হয়। কিসের এ ভাবাবেগ? এমন অনুভূতি তো আগে হয়নি। হাঁটু মুড়ে বসি সুজানের সামনে। সুজান তার দুটি হাত আমার মাথায় রাখেন।

ভেবেছিলাম, অনেক কথা বলবো তাকে। কিভাবে তার লেখার সাথে এক হয়ে পড়েছি, সে কথা। কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারি না। সব আবেগ যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে গেছে। চোখ বেয়ে কেবলই নামছে জল। অথচ সুজান যেন সব দেখতে পাচ্ছেন।

কোনো কথাই তার জেনে নেয়ার ইচ্ছে নেই যেন। শব্দাতীত বিনিময়ে আমার প্রতিটি ভাব অনুদিত হয়ে তার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এটাই তরঙ্গ। যাকে দেখা যায় না অথচ নির্নিমেষ যা প্রবাহিত হচ্ছে, সেই তরঙ্গকে যিনি পাঠ করে নিতে পারেন। প্রতিটি মানুষই তার কাছে সংকেত। শব্দ দিয়ে কতটুকু বা প্রকাশ করা যায়! যা করা যায় না তারও অধিক যা কিছু কোনো এক শব্দহীন দ্যোতনায় বুঁদ হয়ে আছে, সেই পরম বোধই হয়তো ঈশ্বর।

দুমিনিটের জন্য মনে হয় বিভ্রান্ত হতে হতে হয়তো বা পথ ভুলেই সেই ঈশ্বরের কাছাকাছি এসে পড়েছি। দূরে চার্চের ঘণ্টা বাজে। চলবে