শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১৮

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০২১

এতদিন পর ফ্রিতির কাছাকাছি এসে আমার যে অনুভব হয়, সে বড় অদ্ভুত। বাসের জানলা দিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় দূর দূর অবধি, ছোট টিলা উঁচু বৃক্ষ ঘর বাড়ি ক্ষেত ছোট খাটো গ্রাম শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত জনপদ পথঘাট জটলা বাজার এবং নির্জনতা— সবই মায়াঘন লাগে। বেহেস্তের জীবন আধুনিক, কিন্তু সেখানে তেমন বাঁধন নেই। বেহেস্তে আমি মুক্ত। সেই মুক্ত আমি যা কিছু পুরনো অভিমান সর্বস্ব ত্যাগ করে নির্মোহ হয়ে আজ দাঁড়াতে পারবো কি আমার স্মৃতি সত্তার মুখোমুখি?

বাস হর্ন দিয়ে দাঁড়ায় ফ্রিতি নদীর কাঠের সেতুর কাছে। দুহাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে নেমে দাঁড়াই। বাস ধুলো উড়িয়ে চলে যায় পরবর্তী হল্টের দিকে। এই মধ্যাহ্নে একাকী সেই সেতুর মুখোমুখি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এই সেতুর এপারে এক জীবন আর ওপারে আরেক। আমি কি পার হবো এই মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু? নাকি একছুটে পালিয়ে যাব? এসব ভাবতে ভাবতেই এগোতে থাকি। ধীরে ধীরে প্রবেশ করি সেই স্মৃতি পথের ভেতর। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় যেন ঢুকে পড়েছি কোনো এক প্রাচীন সুড়ঙ্গের ভেতর। এমন এক সুড়ঙ্গ যার শেষ কোথায়, কেউ জানে না।

সেতু পার হয়ে ডান দিকে গেলে ফ্রিতি নদী। বাম দিকে বাবুজীর রেস্তরাঁ। ডানদিকের পথ কিছুদূর সোজা এগিয়ে ঢালু হয়ে নেমে গেছে ফ্রিতির ধারে। ব্যাগদুটি নামিয়ে রেখে একটি পাথরের ওপর বসি। সামনে উন্মুক্ত হয়ে বয়ে যাচ্ছে আমার কৈশোর যৌবনের নদী। একদিন এখানেই বসে কতই না স্বপ্ন দেখেছি, কত বেদনার ভারে অশ্রু মোচন করেছি। নদীটি সবই ধারণ করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা কত সময় কেটেছে এখানে। তারপর একদিন চলে গেছি বহুদূর। কিন্তু ফ্রিতিকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি কোনোদিন। কত বিষণ্ণ রাতে মনে মনে এসে বসেছি এই পাথরের ওপর। আমি ও ফ্রিতি মুখোমুখি। সেদিনও ফ্রিতি আমার সব ব্যথা শুষে নিয়েছে নীরবে।

বসে থাকি এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ। তারপর উঠে ধীরে ধীরে এগোই সেই বাসার দিকে যেখানে কেটেছে আমার জীবনের সেরা সময়টুকু জুমেরানের সাথে। গিয়ে দেখি এতদিনের অযত্নে বাসাটি হেলে পড়েছে। টিনের চালের একাংশ নেই। দরজা জানলার কাঠ পচে আলগা হয়ে গেছে। সারা বাড়িটি ছেয়ে গেছে বুনো জঙ্গলে। তবু মনে হতে থাকে এই বুঝি দরজা খুলে এসে দাঁড়াবে জুমেরান। এই ভগ্নস্তূপের ভেতর শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে হয়তো সে অপেক্ষায় আছে আমার। মাথায় হয়েছে জটাজুটো, মুখভর্তি দাড়ি। কিন্তু কেউ দেখা দেয় না। আসন্ন সন্ধ্যা পিঠে নিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে ভেঙে পড়া ইটের স্তূপ, টিন উড়ে যাওয়া বাসার ছাদ, হেলে পড়া জানালা দরজা।

হঠাৎ মেঘ ডাকার শব্দে আমার সম্বিৎ ফেরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, ঘন মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি এলো বলে। মনে পড়ে, যেদিন নিজের ঘর ছেড়ে জুমেরানের আশ্রয়ে এসেছিলাম সেদিনও ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই গহীন বৃষ্টির অন্ধকারের ভেতর থেকে নিজের বুকের ওমের ভেতর আমাকে টেনে নিয়েছিল জুমেরান।

বাবুজীর রেস্তরাঁয় পৌঁছে দেখি, রেস্তরাঁ খোলা কিন্তু বাবুজী সেখানে নেই। যে ছেলেটি রেস্তরাঁ সামলাচ্ছে সে আমাকে দেখে চিনতে পারে। বিষণ্ণ মুখে বলে, বাবুজী বিছানা নিয়েছে অনেকদিন হলো। এখন সেই দায়িত্ব নিয়ে চালাচ্ছে সবকিছু। মাসশেষে হিসেব করে নিজের ভাগের টাকাটুকু রেখে বাকিটা তুলে দেয় বাবুজীর হাতে। আমি তাকে বিদায় জানিয়ে গ্রামের দিকে এগোই, যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম এক দুর্যোগের রাতে, যে বাড়িতে আমার পিতা আমাকে তুলে দিয়েছিল এক ঘৃণ্য পশুর হাতে, সেই বাড়ির দিকে।

বাড়িতে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়ি। দরজা খুলে দেয় এক গ্রাম্য মহিলা, সম্ভবত বাবুজীর দেখাশোনা করে। নিজের পরিচয় দিতে সে বাবুজীর ঘরে নিয়ে যায় আমায়। আধো অন্ধকার ঘরে পরিচিত বিছানায় প্রায় কঙ্কালসার একটি শরীর মিশে আছে। শ্বাস চলছে এই অবধি। দেহাতি মহিলাটি বাবুজীর কানের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে কিছু বলে। বাবুজী চোখ মেলে, আঙুলের ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকে।

বিছানার পাশে একটি ছোট চেয়ার রাখা। আমি সেখানে গিয়ে বসি মাথা নিচু করে। নীরবতা ছাড়া এই মানুষটিকে আমার কিছুই দেয়ার নেই। একটি মানুষ যে কোনো পাপ করতে দ্বিধা করেনি কোনোদিন, আজ সে অসহায় একটি শরীর মাত্র, শরীরে প্রাণবায়ুটুকু আছে শুধু, এছাড়া সম্পূর্ণ অক্ষম। আজ যদি এর ওপর জীবনের যাবতীয় শোধটুকু তুলে নেব ভাবি, কিছুই করে উঠতে পারবে না। এ আমার ঘৃণার যোগ্য নাকি করুণার, বুঝতে পারি না, স্থবির হয়ে বসে থাকি।

হঠাৎ শিরা বের করা নড়বড়ে দুটি অশক্ত হাত আমার হাতদুটি খোঁজে। আমার হাতদুটি কোনোক্রমে নিজের কাঁপা কাঁপা হাতের মধ্যে ধরে জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতে থাকে বাবুজী। আমি এগিয়ে গিয়ে আমার কান তার মুখের কাছে ধরি। এটুকু শুনবো বলেই আমি এত পথ পার করে ছুটে এসেছি। আমাকে জানতেই হবে আজ আমার জীবনের অমীমাংসিত সব প্রশ্নের উত্তর। চলবে