শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২১

কাঠের সেতু থেকে ঢাল বরাবর নেমে আসি ফ্রিতির ধারে। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে পূর্ণ চন্দ্র দ্যুতিমান, নদীর জল সেই জ্যোৎস্নায় চিক চিক করছে। অরণ্যের বুনো গন্ধে বুঁদ চারদিক অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় থমথমে হয়ে আছে। একটি পাথরের ওপর একা বসে জলের দিকে চেয়ে থাকি। স্রোতের আলোড়নে চাঁদ ভেঙে গুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে জলে। আমি দুটি পা ডুবিয়ে বসি গুড়ো চাঁদের ভেতর।

এমনই কত রাত শরীরে অভ্র মেখে বসে থেকেছি জুমেরান ও আমি। অপলক দেখেছি এই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীকে। আজ সেই সব কিছুই উপস্থিত, শুধু জুমেরানের না থাকা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাই বলে সেই সকল মুহূর্ত মিথ্যা হয়ে যায় না। বরং সেও আরও বেশি করে তার রয়ে যাওয়াকেই অনুভবে আনে। যেমন করে জুমেরান এত বেশি করে রয়ে গেছে আমার ভেতর তার না থাকার দরুণ শূন্যতায়।

সে এত গভীরভাবে ছিল বলেই তার না থাকার শূন্যতাও ছিল। কিন্তু আজ আর নিজেকে তেমন করে ফাঁকা লাগছে না। আজ আর কারো না থাকা নেই আমার ভেতর। যেন গোটাটাই শূন্য হয়ে গেছি আমি।

গণ্ডুষ ভরে নেই ফ্রিতির জল। মনে মনে ধুয়ে ফেলি আমার যাবতীয় গ্লানি। আপাদমস্তক স্নাত হই মনে মনে। এই জলেই কি ওরা ভাসিয়ে দিয়েছিল জুমেরানের নিস্পন্দ দেহ? ফ্রিতির জলেই কি ধুয়ে গেছে তার বেদনা বাহিত রক্ত? সে যেখানেই আছে, যেন শান্তি পায়। আমার দুচোখ বেয়ে এবার নামতে থাকে অশ্রু ধারা। তবে তার কোনো দহন অনুভব করি না আর, বরং এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগে।

এক অদ্ভুত নিমগ্নতার ভেতর ডুবে যেতে থাকি। মনে পড়ে যায় সুজানের কথাগুলি: অপেক্ষারও তোমাকে প্রয়োজন, অনুপমা, মৃত্যু অবধি। সে নেই। যে আছে দেখা হোক তার সাথে।

সুজান তবে অনেক আগেই দেখে নিয়েছিলেন আমার অদৃষ্টকে। তিনি জানতেন, জুমেরান আর নেই। কিন্তু অপেক্ষা অন্তহীন, কারণ লক্ষ্য বদলে যেতে থাকে, বদলায় গন্তব্য। এবার তবে কোথায় যাব, মনে মনে ভাবি। কিংবা কে আছে যার সাথে দেখা হবে? এমন সব ভাবনার ভেতর অতিবাহিত হয় গোটা রাত। আলো ফোটে ঠিক তার সময়মতো।

ভোর হতেই সেতুর মুখে বাস ধরি। বেহেস্তে যেতে হবে। আর কোনোদিন ফেরার প্রয়োজন হবে না এখানে। আজীবন ফ্রিতি বইতে থাকবে আমার ভেতর, ফ্রিতির জলে দুলতে থাকবে সেতুর ছায়া। এসব ছবি মনের ভেতর চিরতরে বাকসোবন্দি করে নিয়ে রওনা হই। মিশ্মি আছে আমার অপেক্ষায়।

ডাউনটাউনে নেমে ক্যাবের অপেক্ষা করি। দীর্ঘ যাত্রার একটানা ধকলে খুবই ক্লান্ত। হঠাৎ চমকে উঠি, কেউ যেন দূর থেকে ডেকে ওঠে মা বলে। দেখি, মিশ্মি ছুটে আসছে আমার দিকে। সে এখানে কি করে এলো! মিশ্মি এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে। বলে, আঙ্কেল আমাকে নিয়ে এসেছে। দেখি, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস্তভ। তাকে দেখে কি প্রতিক্রিয়া দেব, বুঝতে পারি না। সে মৃদু হেসে বলে, সান্দ্রা বললো তোমার আজ ফেরার কথা। তাই মিশ্মিকে নিয়ে এলাম। চলো তোমাদের পৌঁছে দেই।

অনেক দিন পর ক্রিস্তভকে দেখে ভালো লাগে। পথে ভাবি, তার প্রতি আর সেই অভিমানও নেই সেভাবে। যে শূন্যতায় সে এসে বসেছিল, যে অপেক্ষায় স্পর্শ করার মতো অবলম্বন সে হয়ে উঠেছিল, সেই শূন্যতা যেন কোনো এক মহাশূন্যতায় মিশে গেছে। সেই অপেক্ষাও আর নেই। ক্রিস্তভকে আজ এক অন্য মানুষ মনে হয়।

বেহেস্তে পৌঁছে ক্রিস্তভের গাড়ি এসে দাঁড়ায় আমার বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামার আগে ক্রিস্তভ আমার হাত দুটি ধরে বলে, যেভাবে চাও আমি আছি তোমার সাথে।

একজন প্রকৃত প্রেমিকই পারে একথা বলতে। আর একজন মুক্ত মানুষই পারে সেই প্রেমে ধরা দিতে। নাহ্। ক্রিস্তভকে ফিরিয়ে দেব না আর আমি। তাকে বসাবো না অন্য কারো শূন্যস্থানে। আমি আজ মুক্ত। আমি পূর্ণ। সেই পূর্ণতায় সেই মুক্তির আনন্দে শরিক হবে ক্রিস্তভ। আমি তার দুটি হাত শক্ত করে ধরি।

সুজান বলেছিলেন, যে আছে দেখা হোক তার সাথে। তবে তাই হোক। দেখা হোক, আরও আরও দেখা হোক, তার সাথে যে আছে আছে আছে...