সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০২১

রতনদার কথামতো ট্রেনটা এসে গতি কমালো একটা নদীর চরের একদম কাছেই। রতনদার কথায় এটাই হচ্ছে ন্যাংটা চর। আমরা সাবধানে নেমে গেলাম। ট্রেনটা চলে গেল সোজা। মিলিয়ে গেল একটু পরেই।

আমি বললাম, আমার সাজা তো শেষ হয়নি। তুমি এই নরক দর্শনে এলে কিভাবে?
রতনদা বলল, বলেছিলাম না, এইভাবেই দেখা হয়ে যাবে এপারে ওপারে। আমি সব জায়গায় বিরাজমান। আমি বইয়ে করে সমস্ত কিছুতে, সব স্থানে চলে যেতে পারি। তুইও পারবি, কারণ তুইও যে এখনও পড়িস। এখনও বোকার মতো।
 
নদীর জল শুকিয়ে গেছে বলা চলে। আর কেউ কোথাও নেই। ধু ধু করছে সাদা বালির চর। সত্যিই পৃথিবীটা এখানে ন্যাংটাই বটে। রতনদা বলল, সুবিমল বাবু আমার খদ্দের ছিলেন। কত বই আমি ওনাকে বিক্রি করেছি। নরক টরক বাজে ঢপ! আসলে উনি তোকে নিয়ে একটু মজা করলেন আর কি... ওনার মজা করার ধাতটা একটু কড়া। অনেকটা বিট প্রজন্মের মতো। নে, এবার খুব কম শব্দে আমাকে বোঝা তো এই জায়গাটা দেখে তোর কি মনে হচ্ছে?
বললাম, শূন্য।
 
রতনদা মাথা নেড়ে কিছুটা সম্মতি দিয়ে বললেন, তা বটে। এটা হচ্ছে তোর জীবনের সবচেয়ে ভাইটাল পয়েন্ট।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন?
রতনদা বললেন, তোর প্রেম হবে এখানে। খুব ক্রুশিয়াল একটা মুহূর্ত। সিরিয়াস থাক, অথবা অভিনয় কর। মেয়েটা আসছে, ওই যে! বলে সে হাতটা উঁচু করে সোজা দেখালো।

আমি দেখলাম সত্যিই একটা মেয়ে আসছে বটে। জিনসের প্যান্ট আর লাল চাদরের নিচে একটা কালো টিশার্ট পরা মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটার চোখে চশমা আছে। কাঁচের ওপারে চোখ দুটো যেন জ্বলছে। চুল ছোট করে কাটা। ঘাড় অবধি। আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলে উঠল, আপনি আমার প্রেমিক?

রতনদা একটু দূরে হাতের ফিনিগানস ওয়েক বইটা বালির তলায় পুঁতে দিচ্ছে। কেন জানি না! আমি উত্তর দেবার আগেই আবার মেয়েটা বলে উঠল, আমি কিন্তু শুধু গল্পের দরকারে নারী চরিত্র বাড়াতে আসিনি। যদিও লেখকের কতকটা সেরকমই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমিই রতনদাকে বলেছিলাম এরকম কারুর সঙ্গে একটা আলাপ করিয়ে দিও যে কাফকার চিঠি পড়ে কেঁদেছে, কিংবা `স্ট্রেঞ্জর`-এর প্রথম লাইনটা আজও যাকে বিস্মিত করে তোলে। রতনদা মারা গেল হুট করে। তারপর আমাকে এই ন্যাংটা চরে আসতে বলে ওই যে বইয়ের বীজ পুঁতে তাতে জল দিচ্ছে।

আমি বললাম, আমি অনেক কিছুই পারি না। আমার নাক ডাকার বদভ্যাস আছে। আমি অনেক কিছু ভাবি কিন্তু করতে গেলে ততটা ঠিক... আমার অনেক মুশকিল। পয়সা কড়ি বিশেষ নেই। আমার সাঁতার জানা নেই। দুদিন ভালো করে কথা হলে তারপর আমি অপেক্ষায় থাকি আবার কবে সেইরকম ভালো কথা হবে...

মেয়েটা হেসে বলল, ভালোবাসায় এত কথা বলতে নেই। জানো না?
রতনদা ফিরে এসে বলল, তোরা গল্প কর, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি। দেখি কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা।

তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটাকে।
তুমি আমায় ঘুম বলে ডাকতে পারো। তুমি ঘুমোবে? আমার কোলে?

মেয়েটার হাতছানিতে একটা আরাম আরাম গন্ধ আছে। আমি ওই বালির চরে ঘুমের কোলে নিভে গেলাম। শান্তি পেলাম... চলবে