সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’

পর্ব ৯

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১

বাড়িটার সামনে একটা বড় বাগান। বাগানে গাছ থাকলেও পাতা নেই বিশেষ। দূরে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। দেওয়ালে ইট বেরিয়ে আছে। আকাশের দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে থাকার মতো দুটো ভাঙা পিলার উঁচু হয়ে আছে। একটার ওপরে একটা চিল বসে আছে দেখতে পেলাম। ঠোঁট দিয়ে নিজের বাঁদিকের দানাটা ঠুকরে নিচ্ছে।

‘বয়েস বেড়ে গেছে। দাড়িটা ভরাট হয়েছে আরও।’ সামনে তাকিয়ে দেখলাম, রতনদা আমার দিকে হেঁটে আসছে। পাশে বিনু দারোয়ান।

`ঘুম, তোমার বয়েস বাড়েনি কেন?` জিজ্ঞেস করলাম ঘুমের দিকে চেয়ে। সেতো অবিকল একই আছে। ছোট চুল আর গোলগোল চশমা নিয়ে।

`তুমি যে আরও বাঁচতে চাও, তাই বেড়ে চলেছ। আমি যে আর প্রত্যাশা করি না কিছুর।` ঘুমের চোখ চিকচিক করে উঠছে কি?

`ভেতরে চলো। দেখবি এখনও ওপারের কাঁটাতার দেখা যায়।` রতনদা আমাকে আর ঘুমকে নিয়ে ইস্কুল বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। আর বিনু দারোয়ান হাসাহাসি মুখে একটা গাছের পাতাহীন শাখায় ঘুড়ি বেঁধে রাখছে। সেই গাছটায় পাতা নেই বটে তবে, ঘুড়ি বাঁধা রয়েছে কয়েকশো। আমার দিকে চেয়ে অল্প হাসল বিনু দারোয়ান।

ইস্কুল বাড়ির ভেতরে ফাঁকা ভাঙা খোলা একটা জায়গা। এখানে একসময় ক্লাস ছিল, বেঞ্চ ছিল বোঝা যায়। কিন্তু এখন আর নেই। ফাঁকা, ভাঙা পড়ে থাকা ইট বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার কান্না পেল ভীষণ। ঘুম আমার হাত চেপে ধরল। রতনদা সেই ইটের স্তূপের ওপর উঠে গেলেন সোজা। তারপর ব্যাগ থেকে বাংলার বোতল বের করে গলায় ঢেলে নিয়ে বললেন, শালা! টিকে থাকতেও দেবে না এরা। এরা চায় মৃত্যু মিছিল! মৃত্যু মিছিল!

রতনদা নেমে আসতেই তার হাত ধরে বললাম, এখানে সবাই তো মারা গেছে রতনদা! মৃত্যু মিছিল আর কাদের? তুমি শান্ত হও। শান্ত হও।

`মৃত্যু কি শুধু জীবিতের হয় নাকি? স্মৃতির হয় না? আর স্মৃতির মৃত্যু কারা ঘটায়, কিসের ধান্দায় তোরা জানিস না?` রতনদার চোখ চলে গেছে ওপারে ইস্কুল বাড়ির বাইরে নদীর ওপাশে যে কারখানাগুলো দেখা যাচ্ছে, সেই দিকে।

ঘুম আমায় বলে উঠল, `রতনদা বড্ড আঘাত পেয়েছে। ওকে সামলাতে হবে। চলো।` বলে সে আমাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল নদীর সামনে যেখানে রতনদা চেয়ে আছে ওপারে। বলছে, শালারা খেয়ালেও কারখানা করে দিয়েছে। যাতে ওপারটা আর দেখতেও না পাই। ওপারে যে আমার বাবার শব, আমার শব। মারা যাবার পরও যে ওপারে আমি যেতে পারছি না। কোনও শুশুক, কোনও জোনাকি আমায় ওপারে নিয়ে যেতে পারেনি।

রতনদা বসে পড়লেন মাটিতে। ঘুম আমার দিকে চেয়ে বলল, সিদ্ধান্ত নাও, সিদ্ধান্ত!

আমি দেখতে পেলাম, নদীর ওপর ডিঙি নৌকায় একটা মেয়ে, বছর দশেক বয়স হবে, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে জলে ঝাঁপ দিল অবলীলায়! আর উঠল না। তলিয়ে গেল কোনো লুপ্ত প্রদেশে। ঘুম আমায় জিজ্ঞেস করল, বিনু দারোয়ান জানবে না? এখন আমাদের কি করা উচিত? কিভাবে ওপারে যাওয়া যায়?

আমি বললাম, সেই ভালো। চলো। রতনদা, তুমি এখানেই থাকো, আমরা আসছি।

আমি আর ঘুম ইস্কুলবাড়ি পেরিয়ে বাগানের সেই ঘুড়ি বাঁধা গাছের কাছে এসে দেখি, বিনু দারোয়ান সেই দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটার লাল পাড় সাদা শাড়িটা শুকোতে দিচ্ছে দড়িতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোথায় পেলে?

`আমার মেয়ের শাড়ি। ও মারা গেছে দশ বছর বয়সে। জলে ডুবে। ওর শাড়িটা ভেসে এসেছিল ওপরে। তুলে রেখেছিলাম। রোজ কেচে শুকোতে দি।` বিনু দারোয়ান হেসে আরও বলল, `দেখতে পাবে পূর্ণিমাকে, ওপারের নদীতে মাঝে মাঝে। ডিঙি নৌকা চরে ঘুরে বেড়ায় তো!`

ঘুম আমার দিকে চেয়ে রইল অবাক চোখে। আমিও ঘুমের দিকে চেয়ে দেখলাম, ওর চোখে রতনদাকে ওপারে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছে আরও। চলবে