সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’

পর্ব ১০

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১

রাত নেমে এসেছে নিশ্চুপে। ইস্কুল বাড়ির পেছনে নদীর ধারে আমরা বসে আছি ঠায়। বিনু দারোয়ান বলেছিল, ‘জলের উপর ছায়ার মতো পূর্ণিমা ভেসে আসবে।’ আর পূর্ণিমাই আমাদের বলে দিতে পারবে, কিভাবে আমরা ওপারে যেতে পারব, ওই কারখানা আর ধোঁয়া আকাশ ছাড়িয়ে যেখানে রতনদার বাবার মৃতদেহ আছে এখনও, কাঁটাতার, ছেঁড়া বর্ণপরিচয়...

আমি বিনু দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই ঘুড়ি বাঁধা গাছের ব্যাপারটা কিরকম?
বিনু দারোয়ান সাদা চুল আর ভুরু দুলিয়ে হেসে বলল, ওটা উড়ন্ত গাছ। রোজ ওই গাছটা উড়ে যায় ঠিক ভোরবেলা, আবার পথ চিনে ফিরে আসে একই জায়গায় সকাল শুরু আগেই। সাতশো বছর ধরে গাছটা তাই করে আসছে। একদিনও পথ ভুল করেনি, দেরি করেনি।

ঘুম একটু দূরে একটা কাচের শিশির মধ্যে গোটা চারেক জোনাকি ধরে তাদের দেখছে কাচের এপার থেকে। আমি ঘুমকে দেখছি অবাক হয়ে। ওর চোখে আলো পড়লে আমার মনের মধ্যে কেমন একটা করে ওঠে। ঘুমও আমাকে দেখছিল আড়চোখে মাঝে মধ্যে।

‘রাতের পর রাত নেমে আসে... চাঁদের নৌকোয় বেশি আসে কে? জ্যোৎস্না?` রতনদা বলে উঠল এতক্ষণ পর। আমি রতনদার পাশটায় সরে গিয়ে বললাম, আমাকেও পুরোপুরি তোমাদের দলে নিয়ে নাও না, রতনদা? বারবার আসা যাওয়া আর ভালো লাগে না।

রতনদা হেসে বলল, তুই যে সব লিখে রাখছিস তোর লেখায়। সেটা পড়ে কিছু বোকা এখানে আসবার স্বপ্ন দেখছে রোজ। তাদের বঞ্চিত করতে বলছিস?

`পূর্ণিমা!` ঘুম চিৎকার করে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই নদীর পারে হুমড়ি খেয়ে খুঁজতে লাগলাম কোথায় সেই দশ বছরের মেয়ে। দেখলাম ঘুম শিশির মধ্যে ধরে থাকা জোনাকিগুলোকে জলে ভাসিয়ে দিল। চারটে জোনাকি সার বেঁধে এগিয়ে যায় পূর্ণিমার প্রতিচ্ছবির দিকে জলের উপর। আমরা তাদের পথ অনুসরণ করে দেখি, কালো জলের নিচ থেকে পূর্ণিমার মুখ ভেসে উঠেছে। অনেক রঙিন মাছ তাকে ঘিরে রেখেছে। পূর্ণিমা কিছু বলতে চাইছে। আমরা জলে নেমে একটু কাছে যাব ভাবছি। অমনি আলোর নৌকো ভেসে এলো আমাদের কাছে। ডিঙি নৌকো, আলোয় ভরা। যেন টুনি আলোয় ভরে আছে বৈঠা, পাল, কাঠের সমস্তটা।

পূর্ণিমা জলের তলা থেকে হাত তালি দিয়ে উঠল।  আর আমরা একে একে সবাই নৌকোয় উঠে পড়লাম। শুধু বিনু দারোয়ান বাদে। সে পাড়ে দাঁড়িয়েই বলে উঠল, অনেকদিন পর মেয়েটা আমার ঘরে এসেছে। ওকে ভাত রেঁধে খাওয়াব, আপনারা ঘুরে আসুন।

ওপারে পৌঁছতে সময় লাগবে, জানি। ঘুম নৌকোর একদম শেষপ্রান্তে এক গেয়ে উঠল, `দিনের শেষে ঘুমের দেশে...` রতনদা বলে উঠল চুপিচুপি, তুই তো আমাদের দলেই। ওদের দলে নেই। খালি সাক্ষী স্বরূপ লেখাগুলো লিখে দিয়ে বারবার ফিরে আয় এই দুনিয়ায়, যার নাম পরাবাস্তব।

দাঁড় টেনে যাচ্ছি আমি আর রতনদা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। চোখে পড়ল সেই চারটে জোনাকি কখন উঠে এসে ঘুমের ভুরুর ওপর বসে আছে দিব্যি। ঘুম আমার দিকে চেয়ে বলল, ভালোবাসার প্রতিশব্দ কি?

আমি বলতে চাইছিলাম যে উত্তরটা সেটা হাসি হয়ে ঝুলে রইল ঠোঁটে। উত্তরটা হচ্ছে, ঘুম। চলবে