সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’

পর্ব ১১

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২১

আলোর নৌকো এসে থামল পুরোনো শ্যাওলা ধরা ঘাটে। রতনদা আগে নামল। তারপর আমি আর ঘুম নেমে এলাম। খেয়াল করলাম, আলোর নৌকোটা আস্তে আস্তে জলে মিশে গেল, যেভাবে নুন গলে যায়! ঘাটের সমস্ত লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে। রতনদা সাবধান করে দিয়ে বলল, এখানে অনুভূতিরা মারা গেছে, স্রেফ অভিনয় বেঁচে আছে, সাবধানে আয়।

ঘুম আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। ফাঁকা ঘাসের পথ, আর বিরাট বিরাট বন্ধ কারখানা নজরে পড়ছে। এগুলো কিসের ফ্যাক্টরি? উত্তর জানা নেই। অল্প হাওয়া বয়ে গেলে কোনও কোনও ফ্যাক্টরির দেওয়ালে আটকে থাকা বিরাট লোহার পাখাগুলো ঘুড়ে যাচ্ছে শব্দ করে।

এগুলো কিসের কারখানা? জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
‘যন্ত্র বানাবার। মানুষকে হিংস্র যন্ত্রমানবে তৈরি করার কল এগুলো। গম্ভীর, অহংকারী আর বিদঘুটে।’ রতনদার চোখ ঘোলাটে দেখাচ্ছে নেশায় নাকি সংশয়ে?

আমি ঘুম আর রতনদা কারখানার মারপ্যাঁচ পেরিয়ে একটা বিরাট ফাঁকা মাঠের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই মাঠজুড়ে প্রচুর কাকতাড়ুয়া ঝুলে আছে ঠায়। কী বীভৎস তাদের রূপ! কী বীভৎস তাদের ফাঁকা শরীরের খোলস!

একটা কাকতাড়ুয়ার নিচে বসে ডায়েরির পাতায় কী যেন লিখছেন সাদা চুলের ভদ্রলোক। আমাদের দেখেই বলে উঠলেন, আমি তো অপেক্ষায় বসে বসে একটা লেখা শুরু করে দিলাম। তোমরা আসতে এত সময় নেবে, কে জানত!

যিনি বললেন কথাগুলো, তিনি আর কেউ নন, নবারুণ ভট্টাচার্য। চোখের চশমার নিচে চোখগুলো শ্যেন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।

`রতন, তোমাদের ওদিকে কি জানি না, তবে এদিকে বিপ্লব শুরু হওয়া প্রয়োজন। আর সেই জন্যেই তোমাদের চাই। এখানে সাংকেতিক বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। ঠিক যেমন হয়েছিল এক সময়ে প্যারিসে। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা শহরের যত ঘড়ি ভেঙে ফেলত। কারণ তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, তৎকালীন সরকার তাদের সময়কে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখানেও আমরা একটা প্রতিবাদ শুরু করেছি, আমরা হাসি ভুলে গেছি। হাসতে ভুলে গেছি। কোনও কথাতেই আমরা হাসছি না। এবার বলো, তোমরা আমাদের পাশে আছো কিনা?` এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে নবারুণবাবু একটু হাঁপিয়ে উঠলেন।

`এ যুদ্ধ আমরা জিতবোই নবারুণদা। তুমি দেখে নিও।` রতনদা বিড়ি জ্বালিয়ে বলল।

`একটা স্বপ্ন না থাকলে মানুষ বাঁচে কিভাবে? A man must dream!` নবারুণবাবুর কথাগুলো পরিচিত মনে হলো। মনে হলো, পাতাল থেকে ভেসে আসছে একশো কণ্ঠস্বর। যারা একসঙ্গে বলছে, A man must dream

`এগুলো কিসের খোলস? কাদের?` ঘুম প্রশ্ন করল।
`সেই সব মানুষদের যারা শব ফেলে, শব্দ ফেলে হিংস্র হওয়ার দিকে নিজেদের বেচে দিয়েছে।` রতনদা বলল। নবারুণ মাটি খুঁড়ে কী যেন একটা বের করার চেষ্টা করছেন। তারপর দেখলাম, ভেজা ভেজা কালো মাটি খুঁড়ে সে একটা পেতলের বন্দুক বের করেছে। সেটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, অতএব বিদ্রোহ যদি করতেই হয়, তাহলে সেটা সশস্ত্র হওয়াই শ্রেয়... চলবে