সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘শশধর মিত্র মৃত’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২২

রাত ১টা বেজে ৫ মিনিট
পুণ্যের ছুরি আর পাপের কাঁচি দিয়ে শশধর মিত্রকে কাটা হলো। ডোমের বাচ্চা সিধু মাল না টেনেই দিব্যি মানুষ কাটতে পারে। তার বাপ তিলক ডোম একটা বোতল খেয়েই তবে ছুরি-কাঁচি হাতে ধরত। জ্যাঠা দীপক পাঁঠা কাটত দেখবার মতো। এক কোপেই মাথা নামিয়ে ফেলত। দুজনেই এখন খরচা হয়েছেন। ডোমের বাচ্চা কিছুতেই মদ ছোঁয় না। বলে, মদে বিষ আছে, খেলেই পেটে পোকা ধরে।

কিন্তু হাতের কাজ একেবারে শিল্পী। ডাক্তারেরা বলে থাকে, তুই সার্জেন আছিস রে সিধু, তোর তুলনা তুই-ই। শুনে সিধু শুনে মুচকি হাসে। আজ রাতে খুব জল হয়েছে। প্রবল বাজ আর বৃষ্টির মধ্যেও বাড়ি ফেরার পথে কী মনে হলো, একবার হাসপাতালের মর্গে পেন্নাম ঠুকে যেতে সাধ হলো সিধুর। তখনই সে দেখে মর্গে একটা তাজা মরা এসেছে। তক্ষুনি ডাক্তার কল্যাণ এসে সিধুকে দেখেই বলে ওঠে, বোঝো, মরাও এসেছে তার সঙ্গে যমদূতও! ভালো হয়েছে। বডি দান। অর্গ্যানগুলো...

সিধু একটা বিড়ি জ্বালিয়ে বলে ওঠে, টেস্টিং করে নেবেন তো? বলেই সে ছুরি আর কাঁচি বের করে কল্যাণের পাশে এসে দাঁড়ায়। সিধু খেয়াল করে, মরাটার চুল পেকেছে, চামড়া কুঁচকেছে, বয়স হয়েছিল নিশ্চয়ই। লোকটা দেখতে ভদ্র।

কী হয়েছিল? জিজ্ঞেস করে সিধু।
কল্যাণ ফাইল দেখে বলে, বলছে তো হার্ট ব্লক।
সিধু বিড়িতে আরও কয়েকটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কত বয়স হবে?
কল্যাণ একটু খোচে গিয়ে বলে, তুই কি বাল পুলিশে চাকরি নিয়েছিস? এত প্রশ্ন কিসের?
সিধু হেসে বলে, বৃষ্টির রাতে ভগবানের দান, বউনি করছি, যেচে বডি দিয়ে গেছে মরার আগে। কত পুণ্য হলো বলেন দিকি!

কল্যাণ হেসে চেয়ার টেনে বলে, আর পুণ্য! খোঁজ নিলে দেখবি, এই মালটাই কত পাপ করে গেছে মরার আগে। পাপ-পুণ্য কি আর এইভাবে বোঝা যায়? তুই খবরের কাগজ পড়িস না? এরপরেও পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস হয়?

সিধু বিড়ি ফেলে পুণ্যের ছুরি আর পাপের কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলল শশধর মিত্রকে। কল্যাণ মুখে সার্জিক্যাল মাস্কটা পরে নেয়। সিধু কিন্তু দিব্যি খালি হাত, বিনা মাস্ক। ওম নম জটেশ্বরাও, তারস্বরে বেজে উঠল সিধুর মোবাইল। সিধু পাশের রাবার শিটে হাত মুছে আলগোছে ফোনটা কানে নেয়।
হ্যালো? বল... হ্যাঁ। কাজে আছি। গিলে মেটে নিয়ে আসবখন! হ্যাঁ, রাখছি!

ফোনটা রাখতেই সে দেখে কল্যাণ ওর দিকে চেয়ে আছে। সিধু অপ্রস্তুত হাসি হাসে। কাজে মন দেয়। শশধরকে কাটে। কল্যাণ টোন কাটে।
আবার গিলে মেটে খাবে!
সিধু শশধরের বুক বরাবর ছুরি দিয়ে কেটে কাঁচি দিয়ে মোলায়েম করে হাত ঢুকিয়েছে শরীরের ভেতর। সে বলে চলে, বৃষ্টির রাত। একটু ঝাল ঝাল করে গিলে মেটে, আহ! খেয়ে দেকবেন স্যার! যা লাগে না...

থেমে যায় সিধুর কথা। কেন? হাতে যেন কী একটা ঠেকল মনে হচ্ছে। কাপড় গোছের কিছু কি? বডির ভেতরে কাপড়? সে একবার দেখে নেয় আড় চোখে কল্যাণ ফাইলের কাগজপত্রে রুটিন কীসব লিখছে। কাঁচি দিয়ে আরেকটু কেটেই ভেতরে কাপড়ের মতো অংশটা আরেকটু টেনে ওপরে তুলতেই সিধু ঘাবড়ে যায়! এযে সত্যিই একটা কাপড়ের টুকরো! সুন্দর করে মোড়ানো। ভেতরে কি একটা ছোটো মতো চৌকো জিনিসও আছে!

সিধু কোনোদিন চুরি করেনি। কত মরার আঙুলে আংটি পেয়েছে ফেরত দিয়েছে নিয়ম করে ডাক্তারদের হাতে। কিন্তু এই ছোট লাল কাপড়ে মোড়ানো চৌকো জিনিসটা যে কী! আর সেটা এই বডির মধ্যে এলো কোথা থেকে, এই কৌতূহলে সেটাকে চুপিচুপি পকেটে পুড়ে নেয় সে। কল্যাণ খেয়ালও করে না সেইদিকে। শুধুমাত্র সিধুর প্যান্টের বাঁ পকেটের মুখে একটু রক্তের দাগ এই প্রমাণ রেখে গেল যে, সে বডির মধ্যের কী একটা যেন সরিয়ে নিল... চলবে

লেখক পরিচিতি: চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা, কলকাতা