সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৭, ২০২১

বহুজন খণ্ডিতভাবে বলে থাকেন যে মার্কস বলেছেন, ‘ধর্ম হচ্ছে আফিম’। কথাটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তারা দেন না বা জানেন না। মার্কস বাস্তবিকপক্ষে বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে জগতের এক সামগ্রিক তত্ত্ব, বৃহৎ সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয় আঙ্গিকে সে-জগতের যুক্তি, তার আধ্যাত্মিক সম্মানের আস্ফালন, তার উদ্দীপনা, তার নৈতিক অনুমোদন, তার দুঃখাপনোদন ও সমর্থনের ব্যাপক ভিত্তি। যেহেতু মানবসত্তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ধর্ম হচ্ছে সেই সত্তার কাল্পনিক বাস্তবায়ন।’

তিনি সামান্য পরেই বলছেন, ‘ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখের প্রকাশ ও বাস্তব দুঃখের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন জগত-পরিবেশে কল্পিত আত্মা। এ হচ্ছে জনতার আফিম’। কী দাঁড়ায় তাহলে? ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে, বিশেষ শক্তি সমাবেশের ফলে ধর্মও প্রতিবাদের একটা রূপ হয়ে ওঠে, সামাজিক দুঃখের ক্ষতিয়ান আর শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। নাট্যকার উৎপল দত্ত লিখেছেন, ‘এ না হয়ে উপায় নেই। অত্যাচারীর শক্তিকে যখন বাস্তব সমাজে রোখা যায় না, বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ যখন সেই অত্যাচারীর পক্ষেই নকীবী করে, তখন নেতৃত্বহীন জনগণ ধর্ম ছাড়া প্রথম কোথায় আশ্রয় নেবে?’

বিশেষ করে পরাধীন দেশে। উৎপল দত্ত পুনরায় তাই বলছেন, পশ্চাদপদ দেশে ‘ধর্মের সম্মান রক্ষা মানেই, বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদীর পরাজয় সুনিশ্চিত করা।’ ধর্মপালনে সকলের যেমন স্বাধীনতা থাকবে, ঠিক একইভাবে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের ভিতরে ধর্ম নিয়ে নানা সম্প্রদায় আছে, ফলে ধর্মের ভিতর থেকেই ধর্ম নিয়ে নানা মত আর পথ আছে। ফলে কোনো ধর্মই প্রশ্নহীন থাকেনি। ইসলাম ধর্ম নবীর মৃত্যুর পর থেকেই বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছেন প্রধানত ইসলামের অনুসারীরা। ইসলামে খারিজিরা আছে, ফাতিমিরা আছে, আছে মুতাজিলাপন্থীর মতো নানা মত। মুতাজিলাপন্থীরা কী মনে করেন সেটা সকলে ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলেই জানতে পারবেন। ধর্মের ইতিহাসে প্রতিটি প্রধান ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং উঠতেই থাকবে। যারা দুর্বল তারা প্রশ্ন তোলাকে ভয় পায়, যারা সবল তারা প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব দেয়। মনে রাখতে হবে, ধর্মগ্রন্থ মাথায় তুলে রাখার জন্য নয়।

ধর্মগ্রন্থ বা কারো গ্রন্থ মাথায় তুলে রাখলেই সেটাকে সম্মান করা হয় না। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে সেটাকে অনুসরণ করলেই সেই গ্রন্থকে সম্মান করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক ধর্মের লোকরা নিজ ধর্মগ্রন্থকে যতোটা সম্মান দেবে, অন্য গ্রন্থকে ততটা সম্মান দেবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে হিন্দু মুসলমানরা পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে কয়েকশো বছর বাস করেছে। নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থকে সম্মান করার সমস্যা হয়নি। ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসার পর যখন “হিন্দুত্ববোধ” চাগিয়ে তোলে, ভারতে হিন্দু মুসলমান বিরোধের বীজ সেদিন রচিত হয়। কিন্তু সেটা খুব বেশি কাজ করেনি প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ব্রিটিশদের ক্ষমতা লাভের একশো বছর পর ১৮৫৭ সালে যে মহাবিদ্রোহ আরম্ভ হয়, ভারতের হিন্দু-মুসলমানরা মিলিতভাবে সেখানে লড়াই করেছে। সম্রাট বাহাদুর শাহ ছিলেন সেই বিদ্রোহের নেতা। বহু প্রাদেশিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন নানাসাহেব, লক্ষীবাঈ, তাতীয়া টোপী, আজিমুল্লাহ প্রমুখ। কিন্তু মহাবিদ্রোহের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল বাংলার বর্ণহিন্দু আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদাররা। ব্রিটিশ শাসকদের দালালী করেছিল তখন তারা।

মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল মধ্যযুগে পৃথিবীর আধুনিক শিক্ষা। মুঘল শাসনে শুধু মুসলমানরা নয়, অন্য ধর্মের লোকরাও মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল তখন খুব কম। রণজিৎ ঘোষ ভারতের শিক্ষার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, বর্তমান যুগে প্রাথমিক শিক্ষা বলতে যা বোঝানো হয়, প্রচীন ভারতে সে অর্থে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। বেদ শিক্ষার প্রস্তুতিই ছিল বাল্যের শিক্ষা। ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বেদ শিক্ষাই ছিল শিক্ষার প্রধান অঙ্গ। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ছিল বেদ নির্ভর, বৌদ্ধ শিক্ষা ছিল বেদ বিরোধী। হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নারী এবং শূদ্ররা হিন্দু শিক্ষাপরিকল্পনার বাইরে ছিল। প্রাচীন যুগের ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ শিক্ষায় লিপি বা লেখার প্রচলন ছিল না। শিক্ষার্থীদের কেবল বেদ মুখস্থ করতে হতো। তিনি লিখেছেন, ‘মুসলিম বিজয়ের পর ভারতের শিক্ষার ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়’। মুঘল যুগে হিন্দু মুসলমান বিরোধ ছিল না। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশরা ক্ষমতায় বসে প্রচার করেছিলেন নানা মিথ্যা। বর্ণহিন্দুরা তখন ব্রিটিশদের সঙ্গে কণ্ঠমিলিয়ে ছিল। বর্ণহিন্দু কারা? ভারতের চরম সুবিধাভোগী একদল সংখ্যালঘু লোক, যারা সংখ্যাগুরু নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানকে শোষণ করতো। নিম্নবর্গের হিন্দুরা কিংবা মুসলমানরা যাদের কাছে ছিল অস্পৃশ্য।

স্মরণ রাখতে হবে, বাংলায় নিম্নবর্গের হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। বরং বাংলার নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমান কৃষক একসঙ্গে মিলে লড়াই করেছিল ব্রিটিশ শাসন আর এইসব বর্ণহিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। বর্ণহিন্দু জমিদাররা ছিল নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমান উভয়ের শত্রু। নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমানরা এইসব বর্ণহিন্দুদের ছুঁয়ে দিলে তাদের জাত ধর্ম চলে যেতো। হিন্দু হিন্দুকে ছুঁয়ে দিলে জাত ধর্ম চলে যায়, কিন্তু শাসক ব্রিটিশদের সঙ্গে মাখামাখি করলে এইসব বর্ণহিন্দুদের জাত যেতো না। কলকাতা শহরে দুর্গপূজার রমরমা আরম্ভ হয় ব্রিটিশের দালাল এইসব বর্ণহিন্দুদের দ্বারা। দুর্গপূজার মণ্ডপে ব্রিটিশ শাসকদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করে এনে মদ মাংস আর মুঘলাই খানা খাওয়ার আসর বসতো। মুসলমান বাবুর্চিরা সেসব রান্না করতো। সারারাত বাঈজীদের নাচ হতো সেখানে। বড় বড় হিন্দু জমিদাররা প্রথম প্রতিযোগিতা করে দুর্গপূজা করতো, তাদের লুটপাটের টাকা ব্যয় হতো এইসব প্রতিযোগিতায়। ভারতের নানাজনের লেখা ইতিহাসগ্রন্থে এসব ঘটনার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। দ্বারকানাথ ইংরেজদের সঙ্গে বসে মদ মাংস খেতেন বলে তাঁর ধার্মিক স্ত্রী নিজের ধর্ম বাঁচাতে স্বামীর সঙ্গে এক শয্যা গ্রহণ করতেন না। পূজামণ্ডপে যতক্ষণ সাহেবরা থাকতো, ততক্ষণ সাধারণ মানুষরা সেখানে ঢুকতে পারতো না।

সকালে সাহেবরা চলে গেলে, সারারাত্রির অপেক্ষামান সাধারণ হিন্দুরা পূজামণ্ডপে ঢুকতে পারতো। কারণ বছরে একবার ধনী জমিদারদের আয়োজিত দুর্গাপূজার মণ্ডপে ঢুকতে পরাটা ছিল গর্বের বিষয়। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের সঙ্গে বর্ণহিন্দু জমিদারদের আচরণটা ছিল প্রভু ভৃত্যের। ফলে এইসব সাধারণ হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়ে নিজেরা চাঁদা তুলে আলাদাভাবে দুর্গপূজা আরম্ভ করে। বহুজনের চাঁদায় সেই পূজামণ্ডপ বসতো বলে সেটাই তখন বারোয়ারী পূজা বলে খ্যাত হয়। প্রথম দশ-বারোজন জমিদার যে দুর্গপূজা শুরু করেছিল, সেটা বারোয়ারী পূজার দ্বারা সারা কলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেইভাবেই দুর্গাপূজা বাঙালী হিন্দুর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাঙালী হিন্দুরা নিজ ভাই কালো অসুরের বিরুদ্ধে দখলদার দুর্গার পূজা করে থাকে। ঠিক যেমন শ্রীলঙ্কার কালো রাবণকে খলনায়ক বানিয়ে দখলদার রামকে রামায়ণের নায়ক বানানো হয়েছিল। বহুবছর পর মধুসূদন দত্ত সেই ধারণার বিপরীতে লিখলেন বিখ্যাত ‘মেঘনাদবধকাব্য’। চলবে