সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ৬

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩০, ২০২১

জওহরলাল ভয় পেয়েছিলেন যে, প্রস্তাবিত সীমান্ত এলাকার বসবাসকারী মানুষদের মতামত নিতে গেলে প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ হয়ে যাবে। সীমান্ত কমিশনের কাজটা হ্রস্বতম সময়ের মধ্যে করা দরকার যাতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঝটপট হতে পারে। বিচার-বিবেচনাহীনভাবে তিনি এই ধরনের কথা বললেন যে, একটা সাময়িক জোড়াতালি দিয়ে তৈরি সীমান্ত নির্ধারিত হলেও ‘সীমান্তের ভিন্ন রূপ বা অদলবদল নিয়ে দুই দল পরে সমঝোতা করে নেবে’।

যশোবন্ত সিংহ আরো জানাচ্ছেন যে, মাউন্টব্যাটেন যে এ ব্যাপারে জওহরলালের সঙ্গে একমত হলেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মনে হয় তাঁরা জনগণকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। জওহরলাল প্রস্তাব দিলেন, সীমান্ত কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হোক যে, মুসলিম-প্রধান আর অমুসলিম-প্রধান পাশাপাশি জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেই ভিত্তিতে দুই বাংলার সীমানা নির্ধারণ করে দিক। মাউন্টব্যাটেন জওহরলালের এই প্রস্তাবও গ্রহণ করলেন। জওহরলাল ও মাউন্টব্যাটেনের এই ধারণার প্রভাব র্যা ডক্লিফের উপরেও পড়েছিল। যদিও মাউন্টব্যাটেন র্যা ডক্লিফকে তাঁর নিজের কাজের পরিধি নির্ণয়ের ক্ষমতা দিয়েছিলেন, বাস্তবে ভাইসরয় নিজেই সেটা ছকে দেন। পরবর্তীকালে র্যা ডক্লিফের ব্যক্তিগত সচিব ক্রিস্টোফার বোমঁ জানান যে, মাউন্টব্যাটেন র্যা ডক্লিফকে পাঞ্জাবের সীমান্ত বদলে ফিরোজপুর তহসিলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করেন। কমিশনের তথাকথিত নিরপেক্ষতা নিয়ে তাই সন্দেহ জাগে। সভাপতি বা চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত নানান চাপের শিকার হলেন আর এই সবের মধ্য দিয়ে যাদের জীবন চিরকালের মতো বদলে গেল, অবিভক্ত ভারতের সেই নাগরিকরা এসব কিছুই জানতে পারলেন না। মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগের গোটা কৌশলটাই ছিল কাউকে থামার বা ভাবার সময় না দিয়ে দ্রুত গতিতে দায়টা সেরে ফেলা। মাউন্টব্যাটেনের এই দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে আজাদ পরে লিখেছেন, র্যা ডক্লিফ তখন সিমলায় অবস্থান করছিলেন। তিনি মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক তাঁকে সীমান্ত কমিশনের প্রধান নিয়োগের দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন কিন্তু প্রস্তাব রাখলেন যে তিনি জরিপ কাজ জুলাইয়ের প্রথমদিকে শুরু করবেন। তিনি দেখালেন যে জুনের প্রচণ্ড গরমে পাঞ্জাবে মাঠসমীক্ষা করা অসম্ভব হবে। জুলাই মানে মাত্র তিন-চার সপ্তাহ বিলম্ব করা। মাউন্টব্যাটেন জানালেন, তিনি বিলম্ব মেনে নিতে রাজি নন এবং তিন-চার সপ্তাহের বিলম্বের তো প্রশ্নই ওঠে না। মাউন্টব্যাটেন কত দ্রুততার সঙ্গে ভারতবিভাগ আর ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন করেছিলেন এটা তার একটা উদাহরণ।

মাউন্টব্যাটেন সৈন্যবাহিনীর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পাকিস্তানের ভাগে থাকবে এক-চতুর্থাংশ সৈন্য আর ভারতের ভাগে তিন-চতুর্থাংশ। কিন্তু আজাদের মনে হয়েছিল, যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচতে হয় সেনাবাহিনীতে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভাজন করা যাবে না। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে কোনো সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখা যায়নি। সামরিক বাহিনীকে যদি রাজনীতির বাইরে রাখা যায় তাহলে নিয়মশৃঙ্খলা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে। আজাদ জানাচ্ছেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমার কংগ্রেসের সহকর্মীবৃন্দ আমার সঙ্গে একমত হলেন না, প্রচণ্ডভাবে আমার মতের বিরোধিতা করলেন। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সেনাবাহিনী বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের এবং ভারতে মুসলিমদের হত্যায় অংশ নিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বের সাম্প্রদায়িক-ঐক্যের সুন্দর ঐতিহ্য তাতে ভঙ্গ হয়েছিল।’ পুরো ঘটনার জন্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তো বটেই, মাউন্টব্যাটেন দায়ী ছিলেন। ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, ভারতীয়রা কতটা নিষ্ঠুর। নিজেরা নিজেরা কীভাবে রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারে। ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানদের রক্তাক্ত এই দাঙ্গার ভিতর দিয়ে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চাইলো, কত বর্বর একটি দেশকে তারা সভ্যতার আলোক পৌঁছে দিয়েছিল।

মাউন্টব্যাটেন দ্রুত সব করতে গিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন আর জওহরলালের ইচ্ছায় তাড়াহুড়ো করে যে র্যা ডক্লিফ লাইন টানা হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণিত হলো। দ্রুততার কারণে তা সুস্থায়ী যুক্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক সীমান্ত রেখে যায়নি; রেখে গেছে অনন্ত, চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব। জওহরলালের চেয়ে মাউন্টব্যাটেনের দায়টা বেশি, কারণ তিনি ছিলেন নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারের লোক। জওহরলাল কী বলেছেন তাতে কিছু যায়-আসে না, মাউন্টব্যাটেন দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে কী করলেন সেটাই বিচার্য বিষয়। লিওনার্ড মোসলে বলেছেন, যে র্যা ডক্লিফ পাঞ্জাব ও বাংলা-বিভাজনের দায়িত্ব দেয়া হয়, সে অঞ্চল তিনি কখনোই চোখে দেখেননি। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির মানচিত্র সম্পর্কেও তাঁর বিশেষ জ্ঞান ছিল না। তাই বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজনের সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে তাঁর বহু সময় লেগে গেল। তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতেও পারেননি। প্রথমে বাংলার মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা পূর্ব বাংলায় চলে গিয়েছিল। যশোর ও খুলনা হয়েছিল ভারতে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ১৭ই আগস্ট র্যা ডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে যশোর-খুলনা পূর্ববাংলায় চলে যায় আর মালদা ও মুর্শিদাবাদ ভারতে চলে আসে। যুক্তি দেখানো হলো, মালদা-মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে চলে গেলে পশ্চিম বাংলা গঙ্গার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ যশোর আর খুলনা ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা এবং মালদা ও মুর্শিদাবাদ ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। মাউন্টব্যাটেন সবসময়ই পক্ষপাতিত্ব করেছেন কংগ্রেসের।  কিন্তু লক্ষ্য করবার বিষয়, ১৫ আগস্ট ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হলো, আবার ১৭ আগস্ট সীমানা পাল্টানো হলো।  দাঙ্গা লাগাবার কতো রকম পথ তৈরি করা হয়েছিল।

এ সিদ্ধান্তগুলি উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ১২ আগস্টেই তৈরি ছিল। মাউন্টব্যাটেন কিন্তু তখনো তা সকলকে ঠিকমতো জানতে না দিয়ে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান আর ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। নতুন দুটি দেশের কেউই জানতো না তাদের সীমান্ত কোথায়, কোথায় সেই দাগ; যে দাগ ধরে এবার হিন্দু আর মুসলমানদের আলাদা হয়ে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হলো স্বাধীনতার দুদিন পর ১৭ আগস্ট। যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেই রকম ভয়াবহ ফল হলো। মাউন্টব্যাটেনকে তাঁর কমান্ডার ইন চিফ অচিনলেক আগেই বলেছিলেন, সীমান্ত-সিদ্ধান্ত তৈরি হয়ে গেছে, সেটা সবাই জানার পরও দেরি করা হলে নানান গুজব ছড়াবে এবং ক্ষতিকর পরিণাম হবে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যকে পাত্তা দেননি ভাইসরয়। ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল পুরোপুরি অস্পষ্ট সীমান্ত ধারণার ভিত্তিতে। ম্যানসারঘ সম্পাদিত ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর মাউন্টব্যাটেন সীমা নির্দেশ করতে আগ্রহী ছিলেন যাতে সকল দায়দায়িত্ব নবগঠিত দু দেশের সরকারের ওপর বর্তায়। মানে দাঙ্গাটা স্বাধীনতালাভের পরে লাগুক। দাঙ্গার দায়টা ব্রিটিশরা নয়, ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া ভারত পাকিস্তান নিক। প্রমাণ করা গেল, ব্রিটিশ শক্তিকে বাদ দিয়ে একটা দিনও দেশ চালাতে পারে না ভারতীয়রা। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটায়। ব্রিটিশ কী চমৎকারভাবে বহুমাস ধরে সেই খেলাটা খেলেছিল। চলবে