উৎপল দত্ত

উৎপল দত্ত

সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ৭

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩১, ২০২১

মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে উৎপল দত্ত বলেছিলেন, মাউন্টব্যাটেন, এরকম একটা পশু যে সাড়ে চার লাখ পাঞ্জাবি আর সাড়ে তিন লাখ বাঙালির হাড়ের ওপর দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে। বিশ্বাসঘাতক নেতাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে দুটো দেশকে ভাগ করে, সেই লোকটাকে আমাদের মেরে ফেলা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি হলেন স্বাধীন ভারতের গভর্নর। কিন্তু যাকে ভারতীয়দের মারা উচিত ছিল, তাকে পরবর্তীতে অবহেলিত আইরিশদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। আইরিশ বিপ্লবীরা যোগ্য কাজটা করে সপরিবারে ওই লোকটাকে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে। কিন্তু সেদিন মাউন্টব্যাটেনের জন্য ভারতে ইন্দিরা গান্ধী, জগজীবন রাম প্রমুখ শোক প্রকাশ করেন; মাউন্টব্যাটেনের মহত্ত্বকে ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ব্রিটিশ সরকার যেদিন ভারত ভাগ ঘোষণা করলো, সেই তেসরা জুন জওহরলাল ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে হস্তান্তরের জন্য একটি দিন ঠিক করার ঘোষণাকে ‘প্রাজ্ঞ ও সাহসী’ বলে বর্ণনা করলেন, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। সুদূরপ্রসারী ফল কী হলো, রক্তের বন্যা বয়ে গেল সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে। মাউন্টব্যাটেন ছিলেন যার প্রধান হোতা।

যখন নিশ্চিতভাবে দেশবিভাগ হতে চলেছে, আজাদ মাউন্টব্যাটেনকে প্রশ্ন করেছিলেন, দেশবিভাগের ফলাফল কী হতে পারে? দেশবিভাগ ছাড়াই যেভাবে দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে তাতে দেশবিভাগের পর রক্তবন্যা বয়ে যাবার কথা। ভাইসরয় জবাব দিলেন, ‘এই একটি ব্যাপারে আপনাকে পূর্ণ আশ্বাস দিচ্ছি। আমি দেখবো যাতে কোনো রক্তপাত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না ঘটতে পারে। নীতিগতভাবে একবার দেশভাগ হয়ে গেলে আমি এই মর্মে নির্দেশ দেব যাতে দেশের কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয়। যদি ক্ষীণতম তিক্ততাও ঘটে আমি এমন ব্যবস্থা নেব যাতে তা সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায়।’ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আশ্বাস দেয়ার পর কী ঘটেছিল সারা বিশ্ব দেখেছে। যখন সত্যি সত্যি দেশবিভাগ হলো তখন বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রক্তনদী বয়ে গেল। ভারত-বিভাজনের পরিণতি হিসেবে দশ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং পঁচাত্তর হাজার নারী পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়। মৃতদেহ বোঝাই রেলগাড়ির সীমান্তের এপার-ওপার যাতায়াত একটি প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। শরণার্থী শিবিরের জঘন্য ও বিবর্ণ পরিবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতার তিক্ত স্বাদ অনুভব করে।

নৃশংসতার বলি হয়ে অসংখ্য হিন্দু ও শিখ পশ্চিম-পাঞ্জাব ত্যাগ করে পূর্ব পাঞ্জাবে চলে আসে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল কিঞ্চিৎ আলাদা। পূর্ববাংলা থেকে যে পরিমাণ মানুষ ভারতে চলে গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমান শরণার্থীর সংখ্যা ছিল কম। বিহার থেকে অনেক মুসলমান শরণার্থী হয়ে চলে এলেন পূর্ববাংলায়। পূর্ব-পাঞ্জাবের মুসলমানরা যে পরিমাণ জমি পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল তার পরিমাণ ছিল ছয় দশমিক সাত একর। পূর্ব-পাঞ্জাবের মুসলমানরা যে পরিমাণ জমি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তার পরিমাণ ছিল চার দশমিক সাত একর। ফলে সীমান্তের ওপার থেকে ভারতে আসা হিন্দু ও শিখরা জমির ঘাটতি অনুভব করেছিলেন। জমির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে জটিল করে তুলেছিল। সিদ্ধার্থ গুহ জানাচ্ছেন, যে সমস্ত সম্পন্ন মুসলমানরা পূর্ব-পাঞ্জাব ত্যাগ করে পাকিস্তান যেতে কিছুটা কুণ্ঠিত ছিলেন, তাঁদের ওপর নেমে এসেছিল হিন্দু ও শিখদের আক্রমণ। কিন্তু সেইসব ঘটনার জন্য দায়ী কে? কারা মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে দেশভাগের জন্য তাড়াহুড়ো করেছিল? দায়ী তবে কারা? এই সব আক্রমণকারী শিখ ও হিন্দুরা, নাকি যারা তাঁদের বাস্তুহারা করেছিল সেইসব মানুষরা?

জিন্নাহ এ কারণেই বারবার পাঞ্জাব আর বাংলা-ভাগের বিরোধী ছিলেন। ইংরেজরা যখন সত্যসত্যই বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করে চলে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জিন্নাহ বিস্মিত ও বিচলিত হয়ে অবিশ্বাসের করুণ হাসি হেসে বড়লাটকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাহলে কি ভারতকে বিশৃঙ্খলা রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের কবলে ফেলে চলে যাবেন?’ মাউন্টব্যাটেনের কাছে ভারতবাসীর জন্য জিন্নাহর এই বিচলিত হওয়ার কোনো মূল্য ছিল না। ভারত ভাগ বা তথাকথিত স্বাধীনতা সম্পর্কে আজাদ লিখেছেন, ‘পনেরোই আগস্ট স্বাধীনতার উষালগ্ন উদযাপনের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। মধ্যরাতে গণপরিষদ মিলিত হলো এবং ঘোষণা করলো যে, ভারত এখন স্বাধীন রাষ্ট্র। পরের দিন গণপরিষদ আবার মিলিত হলো এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন উদ্বোধনী ভাষণ দিলেন। পুরো শহর আনন্দে কোলাহলে পূর্ণ ছিল। এমনকি দেশভাগের যন্ত্রণাও সে মুহূর্তে সবাই ভুলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা লাভে প্রায় উন্মত্ত উল্লাস চলছিল। কিন্তু তা আটচল্লিশ ঘণ্টাও স্থায়ী হলো না। পরের দিনই সাম্প্রদায়িক গোলযোগের সংবাদে রাজধানীতে গভীর বিষাদের ছায়া নামলো।’ গান্ধী স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। স্বাধীনতা দিবসে গান্ধীর অনুপস্থিতি মাউন্টব্যাটেনের মনেও যথেষ্ট অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল।

গান্ধী যে ইচ্ছা করেই এই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে বড় বিয়োগান্তক ঘটনা হলো গান্ধী নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে তাঁকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী এই বৃদ্ধ মানুষটার সেদিন কিছুই করার ছিল না। জিন্নাহ সেদিক থেকে কিছুটা ভাগ্যবান যে, তিনি যেমন মুসলিম লীগকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি, মুসলিম লীগের নেতারা তাঁকে ব্যবহার করার সুযোগ নিতে পারেননি। কিন্তু ভারতের বিভক্তি জিন্নাহকে যে খুশি করেনি তিনি তা কাউকে বলতে পারেননি। ভিন্ন দিকে ভারতের ক্ষমতা যাঁরা লাভ করেছিলেন, সেই কংগ্রেসের গান্ধীকে আর তাঁদের দরকার ছিল না। নিজেদের ক্ষমতা লাভ নিয়েই তাঁরা খুশি ছিলেন। গান্ধী কি সেদিন এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যেমন কংগ্রেসকে ব্যবহার করেছেন নিজের প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্য, কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতারা প্রায় সকলেই তাঁকেও ব্যবহার করেছেন নিজেদের ক্ষমতা লাভের জন্য? জিন্নাহ অনেক বেদনার পরও সেদিন পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। কিন্তু সকলের কাছে মহাত্মা বলে যিনি পরিচিত ছিলেন, তিনি সেদিন ভীষণরকম একা হয়ে গেলেন।

যখন দেশবিভাগের পরপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হলো, সামরিক বাহিনীর তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করার কথা। আজাদ লিখেছেন, ‘দেশবিভাগের পূর্বে সামরিকবাহিনী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ছিল। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যখন দেশভাগ হলো তখন সাম্প্রদায়িক জীবাণু সামরিক বাহিনীতেও সংক্রামিত হয়েছিল। দিল্লিতে অধিকাংশ সৈন্যরা ছিল হিন্দু ও শিখ। কয়েকদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, যদি শহরের আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় তবে সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভর করা যাবে না। ইতিপূর্বে প্রতিশোধমূলক এবং জিম্মিনীতি সংক্রান্ত শিথিল আলোচনায় আমি যথেষ্ট বিক্ষুব্ধ ছিলাম। দিল্লিতে এখন সে নীতির ভয়ঙ্করতম প্রয়োগ লক্ষ করলাম। যদি পশ্চিম-পাঞ্জাবের মুসলমানরা হিন্দু এবং শিখদের হত্যার জন্য দায়ী হয় তবে দিল্লির নিষ্পাপ মুসলমানদের উপর তার প্রতিশোধ কেন গ্রহণ করা হবে? দিল্লির মুসলমানদের মনোবল তখন একেবারে ভেঙে গেছে। শহরের ধনী এবং সুপরিচিত পরিবারগুলি একদম নিঃস্ব অবস্থায় আমার কাছে এলো, একমাত্র পরনের কাপড় ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিল না।’ চলবে