জওহরলাল, গান্ধী ও প্যাটেল

জওহরলাল, গান্ধী ও প্যাটেল

সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ৮

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০১, ২০২১

দেশভাগের পর ভয়াবহ দাঙ্গা যখন শুরু হলো, সমগ্র সময়টা গান্ধী তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং মুসলমানদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার বিধানের জন্য তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। প্রায়ই তিনি জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল ও আজাদকে ডেকে পাঠাতেন এবং শহরের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে বলতেন। তিনি যখন দেখতেন, সত্যিই কী ঘটেছে সে ব্যাপারে জওহরলাল, প্যাটেল আর আজাদের বক্তব্যের মধ্যে অনৈক্য রয়েছে, তখন তিনি কষ্ট পেতেন। স্থানীয় প্রশাসন তখন দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বড় দলটি সর্দার প্যাটেলের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং তিনি যেভাবে সন্তুষ্ট থাকতেন তারা সেভাবেই কাজ করতো। সরকারি কর্মকর্তাদের ছোট দলটি জওহরলাল আর আজাদের অনুসারী ছিল এবং জওহরলালের নির্দেশাবলি কার্যকর করার চেষ্টা চালাতো।

জওহরলাল একদিন গভীর দুঃখের সঙ্গে গান্ধীকে বললেন, দিল্লির এ পরিস্থিতি তিনি সহ্য করতে পারছেন না যে মুসলমান নাগরিকদের কুকুর-বেড়ালের মতো হত্যা করা হচ্ছে। যখন দিল্লিতে মুসলমানদের প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হচ্ছে তখন সর্দার প্যাটেল গান্ধীকে বললেন, জওহরলালের অভিযোগের মধ্যে বাড়াবাড়ি রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু মুসলমানদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য সরকার সম্ভাব্য সবকিছু করছে। এর চেয়ে আর বেশি কিছু করার নেই। জওহরলাল কয়েক মুহূর্ত বাকহীন রইলেন, তারপর হতাশভাবে গান্ধীকে বললেন, যদি এই হয় সর্দারের মনোভাব তবে তার আর কিছু বলার নেই। গান্ধী বললেন যে, তিনি নিজের চোখে দিল্লির মুসলমানদের হত্যা করতে দেখেছেন আর বল্লভভাই প্যাটেল ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী।

হত্যাকাণ্ড দুদিক থেকেই ঘটেছিল। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে শিখ আর হিন্দুরা নিহত হচ্ছিল। সন্দেহ নেই, এর জন্য প্রধানত দায়ী ছিল মাউন্টব্যাটেনের ভ্রান্ত সীমানানির্দেশ নীতি। প্রতিদিন দাঙ্গা আর রক্তপাতের খবর শুনে জিন্নাহ তখন আর ভালো ছিলেন না। শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তিনি তখন শারীরিকভাবে অসুস্থ কিন্তু তা সত্ত্বেও খাদ্যগ্রহণে রুচি ছিল না। দাঙ্গার ভয়াবহতার খবরে তিনি বলতে গেলে আহার করা ছেড়েই দিয়েছিলেন। রাতে নিদ্রা যেতে পারতেন না। সীমান্তের উভয় পার্শ্ব থেকে সে সময়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটের চরম দুর্দশাপূর্ণ ঘটনাবলীর বিবরণ আসছে। গণহত্যার বিবরণ দিয়ে বোন ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে তার দিনের সূত্রপাত হতো এবং মাঝে মধ্যেই অলক্ষিতভাবে তার রুমাল নিজের আর্দ্র চক্ষুকে আবরিত করতো।

করাচীর মেয়র পার্সী জামশেদ নসরওয়ানজী জিন্নার সম্বন্ধে তার জীবনীকার হেক্টর বলিথোর কাছে বলেন, ‘সানুনয় মিনতি, বিশ্বাস করেন শ্রীযুক্ত জিন্নাহ মানবদরদী ছিলেন। কোনোদিনই তার মধ্যে চোখের জল ফেলার প্রবণতা ছিল না; না, আদৌ না। কিন্তু দুবার আমি তাকে অশ্রুমোচন করতে দেখেছি। একবার দেশবিভাগের পর ঊনিশশো আটচল্লিশ সালের জানুয়ারি মাসে। সেসময়ে তার সঙ্গে হিন্দুদের এক শিবিরে গিয়েছিলাম। সকলেই এঁরা পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। শিবিরের বাসিন্দা সেইসব হিন্দুদের দুর্দশা দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। জিন্নাহকে এ সময়ে আরো দু-একজন কাঁদতে দেখেছেন ভারত ভাগের পর মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে। জিন্নাহ এমনকি তখন তার মন্ত্রীদের সঙ্গেও দেখা করতেন না।

যশোবন্ত সিংহ লিখেছেন, যদুবংশের আত্মঘাতী কলহ যেমন তাদের ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ভারতবর্ষ যেন তেমনি এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। গান্ধী তখন পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য অনশন করবার কথা ভাবলেন। গান্ধীর অনশনের দুটি কারণ ছিল। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে টাকা ভাগাভাগি করার কথা ছিল, তার মধ্যে পাকিস্তানের প্রাপ্য পঞ্চান্ন কোটি টাকা ভারত পাকিস্তানকে দিতে অস্বীকার করে। গান্ধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলকে চিঠি লিখে প্রশ্ন করলেন কীভাবে তোমরা এই অধর্ম করতে পারলে। তিনি জানিয়ে দিলেন, দিল্লিতে মুসলমানদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার দাবিতে এবং পাকিস্তানের ন্যায্য প্রাপ্য টাকাটা দিয়ে দেয়ার জন্য তিনি ১২ই জানুয়ারি থেকে অনশন করবেন। সত্যিকার অর্থে এ অনশন ছিল প্যাটেলের মনোভাবের বিরুদ্ধে। পরদিন প্যাটেলের বোম্বাই যাবার কথা।

প্যাটেল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে অনশন নিয়ে তাঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে জানালেন, গান্ধী অযৌক্তিক কারণে অনশন করছেন। প্যাটেল কিছুটা তিক্ততার সঙ্গেই বললেন, গান্ধীজি এমন ভান করছেন যে সর্দার প্যাটেলই মুসলমানদের হত্যার জন্য দায়ী। গান্ধী চিরাচরিত প্রশান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি এখন চীনে নই, দিল্লিতে। আমি আমার নিজের চোখ আর কানকে হারাইনি। যদি তুমি বলো মুসলমানদের অভিযোগ করার কোনোই কারণ নেই, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করতে পারবো না।’

সর্দার প্যাটেল এ উত্তরে বিরক্ত হলেন এবং গান্ধীর সঙ্গে রুক্ষভাবে কথা বললেন। জওহরলাল আর আজাদ গান্ধীর সঙ্গে প্যাটেলের ব্যবহারে আঘাত পেলেন। গান্ধীকে নিয়ে নাট্যকার উৎপল দত্তের রচিত নাটকে এ সময়ে তাঁদের কথাবার্তার লম্বা বিবরণ রয়েছে। প্রথমে সেখানে দেখা যায়, গান্ধীর কাছে বণিক জেহাঙ্গীর প্যাটেলের চিঠি এসেছে। গান্ধী সে চিঠির বক্তব্য জানতে উদগ্রীব। জেহাঙ্গীর প্যাটেল চিঠিতে জানাচ্ছেন, ‘পূজনীয় বাপুজী, এক্ষুনি জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এলাম। জিন্নাহ সাহেব বলেছেন, গান্ধী সারা ভারতের মুসলিমদের একমাত্র সহায়-সম্বল। তিনি যদি করাচী আসেন আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসবো। তিনি আরো বলেছেন, বোম্বাই থেকে করাচী জাহাজে আসাই নিরাপদ।’ গান্ধী চিঠির বাক্য এবং জিন্নাহর অনুরোধের কথা শুনে বললেন, ‘জাহাজে? আমি হেঁটে যাব। বিধ্বস্ত পাঞ্জাবের মধ্যে দিয়ে পদযাত্রা করে যাব জিন্নাহ ভাইয়ের কাছে। তাঁর হাত চেপে ধরবো। দুনিয়া দেখবে কী করে দুই বৃদ্ধ পশুশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সব আবার গড়বো, গোড়া থেকে গড়বো। মাউন্টব্যাটেনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবো আমি আর জিন্নাহ।’

গান্ধী আরো বলছেন, ‘চেষ্টা করে দেখবো ভুল শোধরানো যায় কি না, ভারত-পাকিস্তানের মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা, সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করা যায় কি না।’ গান্ধীর সংলাপ শেষ হতে না হতেই জওহরলাল আর প্যাটেল প্রবেশ করেন। গান্ধী জওহরলাল আর প্যাটেলকে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনেই সশরীরে আমার কুটিরে উপস্থিত।’ প্যাটেল বললেন, ‘বাপুজী, এটাকে ঠিক কুটির বোধহয় বলা যায় না। এটা বিড়লাজীর প্রাসাদোপম অট্টালিকার অংশ।’ প্যাটেল জানতে চাইলেন, গান্ধী আবার অনশন করতে যাচ্ছেন কিনা। গান্ধী বললেন, তিনি অনশন করতে যাচ্ছেন আর কী কারণে যাচ্ছেন। প্যাটেল বললেন, কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। পঞ্চান্ন কোটি টাকা ফিরিয়ে দিলে পাকিস্তান তা দিয়ে অস্ত্র কিনবে আর তা কাশ্মীর-যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে। গান্ধী বললেন, টাকাটা না দেয়া অধর্ম আর কাশ্মীরের যুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। প্যাটেল বললেন, ‘এ কথা আমি স্বীকার করি না যে কাশ্মীরের যুদ্ধটা সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত’। গান্ধী ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘কিছুই স্বীকার করেন না দেখছি। চোখের উপর দেখছি দিল্লির সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড কিন্তু আপনি স্বীকার করেন না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাশ্মীরের যুদ্ধ ব্রিটিশের ইঙ্গিতে শুরু হয়েছে, কিন্তু আপনি স্বীকার করেন না।’

প্যাটেল জবাব দিলেন, ‘যুদ্ধ এখন চলছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তান শত্রুরাষ্ট্র। এই সময়ে যে শত্রুর পক্ষে কথা কয়, অথবা শত্রুর সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনের চোখে সে দণ্ডনীয়।’ প্যাটেল আরো প্রশ্ন করেন, ‘আপনি বোম্বাইয়ের ব্যবসায়ী জেহাঙ্গীর প্যাটেলের হাতে জিন্নাহকে চিঠি পাঠিয়েছেন?’ গান্ধী জানালেন, ‘কাশ্মীরের আত্মঘাতী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য, পাক-ভারত মৈত্রীর জন্য আমি জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।’ প্যাটেল রেগে ফেটে পড়লেন আর বললেন, ‘বাপুজী আপনি দেশদ্রোহী’। প্যাটেলের বক্তব্যে জওহরলাল বিস্মিত হন। প্যাটেলকে বলেন, ‘কাকে কী বলছেন সর্দার সাহেব?’ প্যাটেল বললেন, ‘না, অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। যুদ্ধের মাঝখানে উনি পাকিস্তানে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন।’ গান্ধী বললেন, ‘তাহলে কি চুপচাপ বসে দেখব কিভাবে আপনারা ব্রিটিশ জেনারেলদের নির্দেশে দুই দেশ শ্মশান করে দেন? এ-দেশ কি আপনার নিজস্ব সম্পত্তি?’ প্যাটেল লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘আপনি সরকারের কেউ নন। আইনত কংগ্রেসেরও কেউ নন।’ গান্ধী বললেন, ‘কংগ্রেসের যে আমি কেউ নই, সেটা আপনারা দুজনে মিলে আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিনা প্রতিবাদে আপনাদের কর্তৃত্ব মেনে নেবে এমন একটা নিরীহ লোক আপনাদের প্রয়োজন।’

প্যাটেল বললেন, ‘হ্যাঁ। আজ অকপটে বলার সময় এসেছে। আপনি চান প্রত্যেক কংগ্রেস সদস্য আপনার হাতের পুতুল হয়ে থাকুক। আপনি স্বাধীনচেতা মানুষ সইতে পারেন না। কিন্তু বল্লভভাই প্যটেলকে চেনেননি এখনো। কারুর তাঁবেদার হয়ে আমি থাকতে পারবো না। আমি নিজের নীতি অনুযায়ী কাজ করবো।’ জওহরলাল আর পারলেন না। প্যাটেলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার নীতি কি মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা সমর্থন করে?’ প্যাটেল উত্তর দিলেন, ‘দিল্লিতে যেসব মুসলিমরা মরেছে তারা সবাই ছিল পাকিস্তানের গুপ্তচর।’ গান্ধী জানতে চাইলেন, ‘দু-তিন বছরের শিশুরাও!’ প্যাটেল বললেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ চলছে। এ-অবস্থায় শত্রুকে কোনোরকম সাহায্য করলে আমি ভারতরক্ষা আইনে আপনাকে গ্রেপ্তার করবো। আপনি যে অনশন শুরু করেছেন তা পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। আমি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছি, অনশন ত্যাগ করুন।’ চলবে