মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা গান্ধী

সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

শেষ পর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০২, ২০২১

নাট্যকার উৎপল দত্ত শুধু একজন নাট্যকার, নির্দেশক আর অভিনেতা ছিলেন না; ছিলেন একজন জ্ঞানদীপ্ত মানুষ। তিনি ভারতের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, বিশ্বের ইতিহাস নিয়েও। লিখেছেন নাটক আর ইতিহাস নিয়ে অসাধারণ মাপের নানা গ্রন্থ। বিশ্ব-ইতিহাসের বড় বড় ঘটনাবলি নিয়ে প্রচুর নাটক রচনা ও প্রযোজনা করেছেন। কংগ্রেসের রাজনীতির সমালোচনা করে বিখ্যাত নাটক লিখেছিলেন ‘কল্লোল’ ভারতের নৌবিদ্রোহ নিয়ে, যা তারই নির্দেশনায় বছরের পর বছর কলকাতার পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে চলেছে।

গান্ধীর কট্টর সমালোচক উৎপল দত্ত মনে করেন, গান্ধী জীবনের শেষ দিনগুলিতে; বিশেষ করে ভারত ভাগের পর ইতিবাচক রাজনীতি করেছিলেন। তিনি গান্ধীকে নিয়ে জীবনের শেষদিকে এই নাটকটি রচনা করেন। নাটকের এই বক্তব্য মনে হতে পারে ইতিহাস-আশ্রিত নয়, কিন্তু আসলে পুরোটাই ইতিহাস-আশ্রিত। নাট্যকার উৎপল দত্ত তার নাটকে প্যাটেল-গান্ধীর যে বিরোধের জায়গাটার কথা উল্লেখ করেছেন, সেটা আজাদও দেখিয়েছেন তার গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘যত না সর্দার প্যাটেলের কথা, তার চেয়েও তার সুর আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করলো। আমি ভাবতে লাগলাম গান্ধীর উপর এর প্রতিক্রিয়া কী হবে। প্যাটেল তারই সৃষ্টি এবং তার সহায়তা ছাড়া প্যাটেল কিছুই হতে পারতেন না। অথচ আজ তিনি গান্ধীজীর সঙ্গে এই সুরে কথা বলতে পারলেন!

আমরা বুঝলাম আর কিছু বলা অর্থহীন। প্যাটেল চলে গেলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে জানাজানি হয়ে গেল, গান্ধী অনশন শুরু করেছেন সে মুহূর্তে শুধু দিল্লি নয় সারা ভারতবর্ষ আলোড়িত হলো। দিল্লিতে এর প্রতিক্রিয়া হলো বিদ্যুতের মতো। অসংখ্য লোক এসে গান্ধীজিকে বললেন দিল্লিতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে তাঁরা কাজ করবেন। কিন্তু গান্ধীজি তাঁদের কথায় প্রভাবিত হলেন না। তিনি শর্ত দিলেন, হিন্দু ও শিখদের আক্রমণের কারণে যেসব মুসলমানকে দিল্লি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে তাদেরকে ফিরে আসতে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং তাদেরকে নিজ গৃহে পুনর্বাসিত করতে হবে।

গান্ধীর প্রস্তাবটি ছিল খুব সুন্দর কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সহজ ছিল না। দিল্লি থেকে হাজার হাজার লোক চলে গিয়েছিল এবং পাঞ্জাব থেকে আসা শরণার্থীরা তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরগুলি দখল করেছিল। কয়েকশত বাড়িঘর হলে তা উদ্ধার করা যেত, কিন্তু যখন ঘটনার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ তখন গান্ধীর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা অনেকটা অসম্ভব ছিল। পশ্চিম-পাঞ্জাব থেকে আগতরা নিজেদের শিকড় উপড়ে এসেছে, দিল্লির পরিত্যক্ত বাড়িঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। দিল্লি ছেড়ে যেসব মুসলমানরা পাকিস্তান যাত্রা করেছে তাদের বা ফিরিয়ে আনার উপায় কী? মুসলমানদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, হিন্দু ও শিখদের দখল করা বাড়ি ছাড়তে বলাও সম্ভব নয়। ফলে আজাদ গান্ধীকে খুব অনুনয় করে বোঝালেন তাঁর শর্তটি তুলে নিতে।

সবকিছুর পরেও আজাদ গান্ধীকে ছেড়ে চলে যাননি। বহু পরে গান্ধী নরম হলেন আর বললেন, ‘হিন্দু ও শিখদের অবিলম্বে মুসলমানদের প্রতি সমস্ত আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। মুসলমানরা যাতে আর ভারত ছেড়ে না যায় তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। মুসলমানদের যে-সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দরগাহর ক্ষতিসাধন করা হয়েছে সেগুলি পুনঃনির্মাণ করে দিতে হবে।’ কিন্তু এসব কারণে হিন্দুদের একটি অংশ গান্ধীর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গাটা খালি চোখে দেখা যায়, কিন্তু তার পিছনের নানা ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যায়।

এরই মধ্যে গান্ধীর জীবনের উপর আক্রমণ হয়েছে, তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়নি। তিনি তখন ভারতের জাতির পিতা, ভারতের সেই জাতির পিতাকে ধমকাচ্ছেন প্যাটেল। কী অদ্ভুত সব বৈপরীত্য! স্বাধীনতার পরপরই গান্ধীকে হত্যা করার বিরাট ষড়যন্ত্র চলছিল। মুসলমানরা নয়, হিন্দুদেরই একটা অংশ এই হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। রাজনীতি সোজা পথ ধরে চলে না, বন্ধুদের মধ্যেই শত্রুতা চলে ক্ষমতা নিয়ে।। নাট্যকার উৎপল দত্ত দেখাতে চান, প্যাটেল নিজে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দেখাচ্ছেন, দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য গান্ধী পদব্রজে পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সে পদযাত্রা আরম্ভ হবার কথা ছিল। কিছুতেই প্যাটেল তখন গান্ধীর এই পদযাত্রা মেনে নিতে চাননি।

জওহরলাল এই পদযাত্রার মধ্যে ততটা দোষ না দেখলেও, প্যাটেল ছিলেন তার বিরুদ্ধে অনড়। স্বাধীনতা লাভের পর জওহরলালের সঙ্গে প্যাটেল-এর চাপা বিরোধ প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। পহেলা ফেব্রুয়ারির গান্ধীর পদযাত্রাকে বাধা দানের জন্যই ৩০ জানুয়ারি তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় প্রার্থনাসভাতে বিকাল পাঁচটা সতেরো মিনিটে। জওহরলাল গান্ধীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন, তিনি তবুও কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেননি তাঁকে রক্ষা করার জন্য। কারণ প্যাটেলকে ক্ষেপাতে চাননি তিনি। হিন্দু মহাসভার সমর্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলের হাতেই ছিল আসল ক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রী হলেও নেহরুর হাতে তখন ততটা ক্ষমতা ছিল না। জয়প্রকাশ নারায়ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তিনি তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলকে সংসদে বলেই ছিলেন যে, তিনি গান্ধী-হত্যার দায় এড়াতে পারেন না। গান্ধীর জীবনটা শেষপর্যন্ত শেক্সপিয়রের নাটক-এর চরিত্র কিং লিয়ারের মতো বিয়োগান্তক হলো।