প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সময়ের দুষ্টক্ষত: ওয়েব সিরিজ নাকি মুক্ত অশ্লীলতার চর্চা

জামান শামস

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২০

ওয়েব সিরিজ শব্দটা এখনও হয়তো কারও কারও কাছে অপরিচিত। সহজ ভাষায়, শুধু অনলাইন বা অনলাইন টিভির জন্য তৈরি ও প্রকাশিত ধারাবাহিকের (ধারাবাহিক ভিডিও) নাম ওয়েব সিরিজ। নব্বই দশকে আমেরিকায় এর জন্ম। আমেরিকান লেখক ট্রেসি রিড লিখিত ‘কোয়ান্টামলিঙ্ক সিরিয়াল’ (১৯৮৮-৯৯) দিয়ে এর যাত্রা। বিশ শতকের শেষ দিকে স্কট জাকারিনের সৃষ্টি ‘দ্য স্পট’ দিয়ে জনপ্রিয়তার সিঁড়িতে ওয়েব সিরিজের উত্থান। একুশ শতকে এর বিশ্বভ্রমণ, বিনোদনের প্রভাবশালী বিকল্প মাধ্যম হয়ে ওঠা। পার্শ্ববর্তী ভারতেও এর যাত্রা শুরু অনেক আগে।

যেটুকু জানা যায়,বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা ২০১৭ সালে। ওই বছর ঈদুল ফিতরে টিভির পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে সাত পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’, ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার পায় বিশেষ নাটক ‘উপহার’। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রকাশ পায় একাধিক নাটক।

শয্যাদৃশ্যের প্রয়োজনে কাহিনি, নাকি কাহিনির প্রয়োজনে শয্যাদৃশ্য— এ এখন বিরাট ধাঁধা। হালের কিছু ওয়েব সিরিজকে ঘিরে ফেসবুকে এখন এমন অসংখ্য মন্তব্যের ঝড়। বাংলাদেশের দর্শক কখনও কল্পনা করেনি, নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পর্নোসদৃশ কিছু দেখতে হবে। কখনও ভাবেনি, শালীন-কুলীন প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন নগ্ন ও অশালীনরূপে তাদের সামনে হাজির হবে। এই সংক্রান্ত লেখা থেকে জেনেছি, তাদের সংলাপে ভাষা অশ্লীল-অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য! অভিনয় ও দৃশ্যনির্মাণ যৌনতা প্রকাশক। সম্প্রতি ‘বুমেরাং’, ‘সদরঘাটের টাইগার’, ‘১৪ আগস্ট’ নামের ওয়েব সিরিজ দেখতে গিয়ে দর্শকরা এমনই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।

অবশ্য তাতে বিব্রত নয় শিল্পী-কুশীলব কিংবা নির্মাতারা। তাদের কাছে সবকিছুই নাকি ‘গল্পের প্রয়োজনে’! কী সেলুকাস! ভিডিওগুলোয় যৌনতার বাণিজ্যিক সমীকরণ খুব সুস্পষ্ট। সুস্পষ্ট অশ্লীলতার ব্যাকরণ। তাতে দর্শকমনে আশঙ্কা জাগছে— ‘হিট’-এর সোনার হরিণ ধরতে আমাদের নাটক কি এখন তবে যৌনতার ঘোড়ায় ভর করেছে? নাটকের ভিউ পাওয়ার ট্রেন্ড কি তবে পাল্টে যাচ্ছে? নাট্যরস নিতে গিয়ে দর্শককে কি এখন নিয়মিত, গল্পের প্রয়োজনে (?) রগরগে যৌনরস বা খিস্তি-খেউড় গিলতে হবে? অবশ্য ওয়েব সিরিজ নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এই তো কয়দিন আগে যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে জনপ্রিয় ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘ট্রিপল এক্স’র প্রযোজকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। ২০১৮ সালে নেটফ্লিস্ক, আমাজন প্রাইম ভিডিওসহ আরও কিছু অনলাইন প্ল্যাটফরমের অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ওয়েব সিরিজ সরাতে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা হয়। মামলা হয় জনপ্রিয় সেক্রেড গেমস, হাসমুখ বেতাল, পাতাল লকসহ বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও বিতর্ক আর ওয়েব সিরিজ যথারীতি হাত ধরাধরি করেই চলছে।

বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ওয়েব সিরিজের দর্শক হলো তরুণ শ্রেণি। এখন যারা ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করছে তাদের অবশ্যই সচেতন থাকা প্রয়োজন যাতে আমাদের সংস্কৃতি কিংবা তরুণদের মূল্যবোধের অবক্ষয় না ঘটে। তাছাড়া আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো সাংগঠনিকভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা-অভিনেতারা এই বিষয়ে সরকারেরও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। দেশের বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল থেকে এই ধরনের অশ্লীল সিরিজ প্রকাশ হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টদের মতে, চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের মতো ওয়েব সিরিজের জন্য সেন্সর বোর্ড থাকার প্রয়োজনীয়তা দ্রুত দেখা দিচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কিছু নির্মাণ হলে যেন প্রদক্ষেপ নেয়া যায় তার জন্য সেন্সরের প্রয়োজন।