সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রৌদ্রস্নাত স্কুল’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২৩

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। আমাকে হাই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। বাড়ির তিন দিকে তিনটি স্কুল। দক্ষিণে নাওভাঙ্গা-জয়পুর উচ্চবিদ্যালয়, পুবে চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয় এবং উত্তরে এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়। কিন্তু কোনোটিই কাছে নয়। তবে এলাকার স্কুল নাওভাঙ্গা-জয়পুর উচ্চবিদ্যালয়। গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এই স্কুলে পড়ে। আমাদের এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয়। ওই স্কুলে গ্রামের কেউ যায় না। আর এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়ও দূরে, তবে আমাদের গ্রাম জহিরাবাদের উত্তরাঞ্চলের কেউ কেউ ওই স্কুলে পড়ে।

 

তখন গ্রামের মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকত না। অতি সামান্য কৃষিজমির উপর ভর করে চলত অধিকাংশ মানুষের সংসার। কিন্তু ওই জমিটুকুর ফসলে সংসার চলত না। সুতরাং অন্যের জমি চাষাবাদ করা; খেতে বদলি দেওয়া বা মজুর খাটা; মাটি কাটার কাজ করা; ঘর বানানোর কাজ করা; ফলমূল, সাক-সবজি বাজারে বিক্রি করা- এ রকম জোড়াতালি দিয়ে চলত অনেকের সংসার।

 

আমাদের মহল্লায় কয়েকটি বাড়িতে ছিল মাছ ধরে রাখার ডুলা বানানোর কুটির শিল্পের কাজ। আমাদের বাড়িতেও কয়েকটি পরিবার বাঁশ, গুনা বা তার ও বেত দিয়ে এই ডুলা বানানোর কাজ করত। আবার কেউ কেউ বানাত ডালা, চালুন, ঠেলা জাল, পলো, চাঙ্গাড়ি এইসব। এই হতদরিদ্র মহল্লাটিতে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা কারোরই ছিল না। তবে যে বয়সে শিশুরা উপার্জনের যোগ্য হতো না সে সময় তাদের কেউ কেউ বাড়ির কাছে প্রাইমারি স্কুলে যেত। সেটাও আবার দুই থেকে তিন বছরের বেশি নয়। ওইটুকু পড়তে খরচ তেমন ছিল না বললেই চলে। এক-দুটি বই, কাঠের বা পোড়ামাটির স্লেট; কখনো কখনো খাতা, কাঠপেনসিল এবং ফাউন্টেন পেন। সবসময় যে এইসব পাঠসামগ্রি কিনতে হতো, তাও নয়। আর স্কুল তো ছিল ফ্রি। মাসে মাসে বেতন দিতে হতো না। এমন নিখরচার মধ্যেও শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ ছিল না। পুরুষানুক্রমে যে পেশায় তারা নিয়োজিত, সন্তানরা সে পেশায় বেঁচে থাকবে- এমনই ছিল তাদের জীবনযাপনের ধারা। শিক্ষা যে অন্যরকম একটা ব্যাপার, সবকিছু পালটে দেয়- এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা ছিল না। তবুও প্রাথমিক শিক্ষাটা যেহেতু ঘরের কাছে এবং বিনামূল্যে সেহেতু ওই শিক্ষার কিছু তাপ শিশুদের গায়ে লাগত। কিন্তু ওর আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার আগেই তারা পূর্বপুরুষদের ধারায় ফিরে যেত।

 

খুব মনে পড়ে, আমাদের প্রিয় খইল্যাইজুর (খলিল ভাইজু। তার দোকান ছিল। ওই দোকানটি ছিল আমাদের স্বপ্নের যাদুঘর।) একটি ছেলে মিনহাজ সানকি ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে খুব আলোড়ন তুলেছিল। মুখে মুখে সে বইয়ের সব অংক করে ফেলত। স্কুলের শিক্ষকগণ ওকে খুব প্রশংসা করতেন। আর আমাদের মা-বাবারা খুব খেপে গেলেন, বিশেষ করে মায়েরা। কারণ, মায়েদের শাড়ীর আঁচলের কাছেপিঠেই তখন ছিল আমাদের জগৎ। তাই মা আমাদের খুব পেয়ে যেতেন এবং বলতেন, “খইল্লার পুতে ভাত খায় আর তোর কি গু খাস? অংক পারছ না কিলিগা? যা, মিনহাজের পা ধুইয়া পানি খাইয়া আয়।”

 

কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে, মা আমাদের বকেন কেন? মিনহাজ অংকে ভালো, এই দোষ তো ওর- আমরা তার কী করব? আর পড়াশুনায় ভালো-মন্দ, পাস-ফেল সম্পর্কেও আমদের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু মিনহাজকে আমরা শত্রু মনে করতাম। পরিষ্কার মনে আছে, গাছে উঠতে হবে। আমাদের বন্ধুদের সবাইকে আমরা পিছন দিক থেকে ঠেলে গাছে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মিনহাজকে ঠেলে দিইনি, ও গাছে উঠতে পারেনি।

 

পরে দেখেছি, পরীক্ষায় পাস-ফেল নিয়ে আমার মেয়ে সেঁজুতিরও একই রকম ধারণা ছিল। সেঁজুতি এখন বুয়েটে পড়ে। মেডিকেলেও সে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু পড়েনি। অথচ যখন সে একদম শিশু তখন তার অবস্থা কেমন ছিল! খিলগাঁওয়ের বাসাসংলগ্ন উদয় শিশু নিকেতন নামে একটি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করেছিলাম তাকে। ওটা তার প্রথম স্কুল। শিশু শ্রেণিতে সে ফেল করে খুব খুশি হয়েছিল। রেজাল্ট নিয়ে বাসায় এসে সে গদগদ হয়ে বলেছিল “আম্মু আম্মু, আমি ফেল করতে পেরেছি।” এবং এ অবস্থায় তার রোল যখন অনেক পিছিয়ে ১৪-১৫ হয়ে যায়, তখনও সে খুব খুশি হয়েছিল। কারণ ১-২ এর চেয়ে ১৪-১৫ অনেক বেশি। ১-২ এর চেয়ে ১৪-১৫ যে অনেক বেশি, তার এই বুদ্ধি হয়েছে জেনে আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম “বাহ! তাই তো, তুমি অনেক বেশি রোল নম্বর পেয়েছ।”

 

আমার এই কন্যার মতোই শৈশবে পরীক্ষা নিয়ে আমাদের ধারণা এমনই ছিল। ভালো-মন্দ রেজাল্টের বিষয় বুঝতাম না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বছর তিনেক পরে খলিল ভাইজুর ছেলে মিনহাজ আর স্কুলে যায়নি। সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এতে আমরা যারা অংক পারতাম না তারা খুশি হয়েছিলাম কি না তা আর আজ মনে নেই।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক