সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রৌদ্রস্নাত স্কুল’

পর্ব ২

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০২৩

কিন্তু হাইস্কুল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওখানে পড়ার বয়সটা প্রথমত রোজগারের উপযোগী এবং দ্বিতীয়ত রোজগার না করে উলটো মাসে মাসে স্কুলে বেতন দিতে হয়। টাকা খরচ করে প্রচুর বইপুস্তক খাতা-কলম কিনতে হয়। আর অনেকেরই যেতে হতো বাড়ি থেকে বহু দূরের স্কুলে। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি এ যুগের ডিটেকটিভ কাহিনিকেও হার মানাবে। কত বন্ধুর পথ, খাল-বিল, নদীনালা পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো! আলাদা তেমন কোনো রাস্তা ছিল না। বাড়ির পর বাড়ি করে করে যে গ্রাম তৈরি হয়েছে তাই ছিল রাস্তা। আবার কিছু রাস্তাও ছিল। সেই রাস্তার শ্রীছাঁদ আজকে কল্পনাও করা যাবে না। মানুষের ঘরের ভিটির পেছন দিয়ে কিংবা ভিটি বেয়ে; খড় বা টিনের চালের নিচ দিয়ে; দুই ভিটির মাঝখানের সংকীর্ণ সুরঙ্গ পার হয়ে; রান্না ঘরের ধুমায়িত বাতাস পার হয়ে; গোয়াল ঘরের পেছন দিয়ে গোবর আর চনা মাড়িয়ে; খোলা পায়খানার সামনে দিয়ে; পুকুরের পাড় দিয়ে; রোদে দেওয়া ছেড়া কাপড়ছোপড়, তেলচিটচিটে কাথা, লুঙ্গি, গামছা আর বস্তাবাস্তির ফাঁকফোকর গলিয়ে, লাউ-কুমড়ার মাচানের নিচ দিয়ে; উচিয়ে থাকা পেড়েক, কাঁটা, বাঁশ আর কঞ্চির আঘাত বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এবং কর্দমাক্ত রাস্তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভাঙা চুড়ি, কাচ, কাঁটা, বাঁশের ধারালো কঞ্চি, ইট-সুরকির কৌণিক টুকরো, ভাঙা শামুক এবং এহেন নানারকম শত্রু মোকাবেলা করে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হতো।

 

বর্ষাকালে নৌকায় স্কুলে যাওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু নৌকা যে সবসময় পাওয়া যেত, তা নয়। আবার ওই নৌকা যে সবসময় নিরাপদ ছিল, তাও নয়। দুষ্টু ছেলমেয়েরা হাসির খোরক তৈরি করার জন্য নৌকা দোলানো শুরু করত। এমন পরিস্থিতিতে সবাই যখন হৈহৈ রৈরৈ করে উঠত তখন কিছুতেই নৌকাডুবি থেকে বাঁচা যেত না। সে সময় একমাত্র চেষ্টা থকত, দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য বইগুলোকে বাঁচানো। নৌকা যখন থাকত না তখন একমাত্র বিকল্প ছিল পাজোড়া। স্রোতের তোড়ে ভেঙে যাওয়া রাস্তা, সাঁকো বা পুল, বাঁধ ভেঙে যাওয়া শরুপথ পার হতে হতো নানা কায়দায়। কখনো কখনো এদিক-সেদিক তাকিয়ে লুঙ্গি বাঁচিয়ে পাড় হতে হতো আঠাঁই খাল। এক হাতে বই উচিয়ে ধরে সাঁতরিয়ে খাল-বিল পাড় হওয়ার দৃশ্য তো খুব পুরনো নয়।

 

অতিরিক্ত টাকা খরচ করে সীমিত পরিসরে প্রাইভেট পড়ার প্রচলন তখনো ছিল। সার্ট-প্যান্ট-জুতা পরতে না হলেও একটু ভালো ও পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয় তো ছিলই। তার জন্য টাকা খরচের সামর্থ্যরে বিষয় ছিল। আর সকালে খেয়ে বা না-খেয়ে যেতে হতো স্কুলে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। মাঝে অঞ্জুলিতে করে কলের পানি পান করা ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। স্কুলব্যাগ বহন করতে দেখিনি কাউকেই। বাড়ি থেকে নাস্তা নিয়ে আসার সামর্থ্য ও সংস্কৃতি ছিল না। তবে স্কুলের বাইরে দুই-একজন হকার বসে থাকতেন। দু-চার পয়সা খরচ করে ওদের কাছ থেকে চাল ভাজা, চিড়া বা মুড়ির মোয়া, তিলের খাজা, চিৎমিঠাই, কাচকলার ভর্তা, বরুইর ভর্তা, আমের ভর্তা, নানা রকম আচার, সাদা ও রঙিন কদমা (ওই কদমার গায়ে কদম ফুলের মতো দাগকাটা থাকত), চিনি দিয়ে তৈরি হাতি-ঘোড়ার ছাঁচে বানানো কদমা, বেলপুরি, মুরালি, নোনতা নিমকি, গুরের বাতাসা, খাগড়াই, বরফে সামান্য মিষ্টি ও রং দিয়ে তৈরি আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, চানাচুর এইসব খাবার পাওয়া যেত। সব যে একই সময় একসঙ্গে পাওয় যেত, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফেরিওয়লা ঘুরেফিরে এইসব খাবারই রাখতেন। যাদের হাতে দু-চার পয়সা থাকত তারা এইসব খাবার কিনে খেত।

 

জাঙ্ক ফুডের নাম অমরা শুনিনি এবং ওইসব খাবারে কৃত্রিম রং, ইস্ট, ই-কোলাই, কলিফর্ম, মাইকোটক্সিন ও সালমোলিনারের মতো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছিল কি না তা কখনোই কারো মাথায় আসেনি। আমাদের মাথায় তো নয়ই, এমনকি আমাদের শিক্ষকগণ এই নিয়ে কখনো চিন্তা করেননি।

 

এমন অবস্থায় প্রাইমারি পাস করার পর অধিকাংশ মেয়ে আর হাইস্কুলে যেত না। ড্রপ আউট। ছেলেদের মধ্যে যারা যেত তাদের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। আগে যাকে মাইনর পাস বলত মানে ফাইভ পাস, সেই মাইনর পাস ডিগ্রি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো আমাদের গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েদের। আর হাইস্কুলে যারা যেত তাদের মা-বাবার সারাক্ষণ চিন্তা থাকত প্রায় বিনা পয়সায় পড়ানো যায় কোথায়। একটু ভালো ছাত্র হলে তাকে নিয়ে আবার ছিল স্কুলগুলোর কাড়াকাড়ি। চলবে