সরকার আবদুল মান্নানের স্মৃতিগদ্য ‘আমাদের গ্রাম’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৭, ২০২০

আষাঢ়-শ্রাবণে জেগে থাকা ভূমির পরিমাণ আর কতটুকু! সর্বত্র শুধু জল আর জল। বিলে তখন ধান আর পাট আর ধঞ্চা, আর শোলা। শ্রাবণ থেকেই বিল জুড়ে ফুটতে থাকে ফুল। পাটে ফুল, ধইঞ্চায় ফুল, শোলায় ফুল। আর পদ্মফুল, শাপলা ফুল, শালুক ফুল তো আছেই। বর্ষার আঠাঁই জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পাট কাটা শেষ হলে ওই খালি জমিতে বিপুল সমারোহে ফুটতে থাকত পদ্মফুল আর শাপলা ফুল। দূর থেকে মনে হতো রাতের এক টুকরো আকাশ- তরায় তারায় ভরপুর।
 
আরও আছে হলুদ রঙের ছোট ছোট ঝাঁঝি ফুল, সাদা চাঁদমালা ফুল। জলের তলে ভাসমান কলমির ঝাড়, হেলেঞ্চার ঝাড়, যেন ফুলের পালকি, বয়ে বেড়াচ্ছে জলবেয়ারার দল। কচুরিপানা নিশ্চয়ই ফালতু। কিন্তু পানাফুল? সাদা হলুদ আর নীলের মিশ্রণে কি যে সুন্দর! জলের স্রোতে ভেসে বেড়ানোর সুযোগ না পেলে দুঃখ নেয় না কচুরিপানারা। ওরা কাদার মধ্যেই গেঁথে নেয় দাড়ির মতো দেখতে খয়েরি আর কালোর মিশ্রণে গজিয়ে ওঠা মূলগুলো। ডাঙায় ওদের এই সাম্রাজ্য বর্ষার শেষে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ছয় পাঁপড়ির মধ্যেখানটিতে ময়ূরের পেখম। মনপ্রাণ দিয়ে না দেখলে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব নয়। তা হলে কচুরিপানাও নিশ্চয়ই ফালতু নয়। গ্রামে যারা গোরু পালেন তাদের আশ্রয় ছিল কচুরিপানা। গোরুর খুবই উপাদেয় খাবার। তবে কোনো কোনো কচুরিপানা খেয়ে গোরুর পেট খারাপ হওয়ার কথাও শুনেছি। কিন্তু গ্রামে এমন শিশু বিরল যে পানাফুল নিয়ে খেলেনি, পানাফুলের মুঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়নি।

ডাঙ্গায় বা ডাঙ্গার কাছাকাছি তখন অসংখ্য ফুলের বিপুল সমারোহ। খালের পাড়ে, ডাঙ্গায় কদম ফুল। এমন বিস্ময়কর সুন্দর ফুল, এমন মিষ্টি গন্ধের ফুল, এমন রোম্যান্টিক ফুল পৃথিবীতে বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক গান লিখেছিন : "শ্রাবণ দিনের প্রথম কদম ফুল ..."।

জহিরাবাদ মাঠের বিশাল পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে ছিল কেয়াবন। বর্ষায় ওই কেয়াবনে পাখির পালকের মতো সাদা কেয়া ফুলে ভরে যেত প্রান্তর। গাঢ় সবুজ কেয়া পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে অসংখ্য কেয়া ফুল নবীন আনন্দে বেরিয়ে আসত বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ আলোর বাতাসে। কেয়া ফুলের গন্ধে বাতাস তখন বিমোহিত। অবিরাম বৃষ্টির ভেতরে গতিহীন বাতাস ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণভরে উপভোগ করে নিত কেয়া ফুলের গন্ধ।

ওই মাঠে কত খেলা, কত বন্ধু, কত মান, কত রাগ, কত বিরাগ। ওই মাঠের দখল নিয়ে কত ঝগড়া, কত মারামারি, কত কি। কোথায় হারিয়ে গেল খালের পশ্চিম পাড়ের বিশাল সেই মাঠ! এখন স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে ওই মাঠের কেয়াবন আর শ্রাবণে বৃষ্টিভেজা মিষ্টি গন্ধের অর্ঘ্য সাজানো কেয়া ফুল।

ওই মাঠের দক্ষিণ পাশে উঁচু স্থানটিতে ছিল কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই বর্ষায় জলসন্নিকটস্থ সাদা কেয়া ফুলের সৌম্য-শুভ্রতার প্রতিদ্বন্দ্বী যেন হয়ে উঠত বর্ষার জল থেকে অনেক উপরের বাসিন্দা কৃষ্ণচূড়া ফুল। জলে আর ডাঙ্গায় তার পাপড়ি পড়ে পড়ে লাল হয়ে থাকত ওই এলাকাটা। কিছু পাপড়ি জলে ভেসে ভেসে চলে যেত কিশোর-কিশোরীদের স্নানের ঘাটে। ওই নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের কত আবেগ, কত রোমাঞ্চ, কত বিনিময়।

জহিরবাদ সরকারি প্রাইমারি স্কুলে এবং স্কুল থেকে এনায়েত ভাইদের বাড়ির দিকে যেতে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল গাছ আর গাছ। প্রচুর নারকেল, সুপারি আর তাল গাছের সমরোহের মধ্যে বেশ কয়েকটি সেগুন গাছ ছিল বিলের দিকে। বর্ষায় ফুটত সেগুন ফুল। বিশাল পাতার নিচে সাদা ফুলগুলো কি যে সংগোপনে ভেজা আলোর মতো অফুরন্ত হয়ে থাকত তার কোনো তুলনা চলে না। খান বাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিকে খালের পাড়ে ছিল একটি স্বর্ণচাঁপা গাছ। নৌকায় যেতে যেতে দেখতাম, কম পাতার মাঝারি উচ্চতার গাছটি হলুদ ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। লম্বা লম্বা পাতা আর চিকন ডালপালা এড়িয়ে লম্বা ফুলগুলো কখনো হলুদ, কখনো হাল্কা হলুদ এবং কখনো বা সাদা। আর কি যে মিষ্টি গন্ধ। গ্রামের মানুষ যে কী! এত সুন্দর ফুলের দিকে যেন তাকিয়ে দেখারও সময় নেই। অথচ ঢাকা শহরে দেখি ওই স্বর্ণচাঁপা ফুল গোছায় গোছায় বেঁধে রাস্তায় বিক্রি করে পথশিশুরা।

আর কলাবতী ফুল? ওর কোনো পাত্তাই ছিলনা আমাদের কাছে। `পথের পাঁচালী` উপন্যাসে হরিহরের স্ত্রীর নাম আমাদের অনেকরই জানা। উপন্যাস পড়ে কিংবা সত্যজিত রায়ের সিনেমা দেখে। তিনি হলেন সর্বজয়া। কলাবতীর আরেক নাম ওই সর্বজয়া। কিন্তু শৈশবে দেখেছি, এই সর্বজয়া কারো হৃদয়ই জয় করতে পারছে না। খালের পাড়ে, পুকুরের পড়ে, নালা-ডোবার পাড়ে অনেকটা ভুট্টা গাছের মতো দেখতে কলাবতী গাছে লম্বা ডাটের মধ্যে ফুটে থাকত কলাবতী ফুল। ঢাকা শহরে দেখি ওই কলাবতী ফুলও বিক্রি হচ্ছে। এখানে সত্যিকর অর্থে কলাবতী সর্বজয়া।

কচুফুল যারা দেখেনি তারা ভাবতেই পারবে না যে ফুল কত সুন্দর হতে পারে। ঠোঙার মতো বিশাল একটি সাদা পাপড়ির মাঝে ধূসর রঙের গর্ভকেশর দেখে যারা মনে করছেন এ আর এমন সুন্দর কি। তাদের বলব আপনি চাষের কচু দেখেছেন। খাবার উপযোগী কচুর ফুল তেমন সুন্দর নয় । কিন্তু বর্ষার জলে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বিচিত্র রকম কচু গাছ জন্মে। ওগুলো বন্য কচু। বন্য কচুর ফুলে রঙের সমারোহ ঘটে। বিচিত্র রঙের সেই সমারোহ দেখলে মনে হবে আহাহা, একটু ছুঁয়ে দেখি না! কিন্তু সুন্দরের তো দেমাগ থাকবেই। সুন্দর সহজলভ্য হলে তার কি দাম থাকে? থাকে না। তাই ওদের ধরতে মানা। আমরা ধরতাম না। কারণ কীভাবে যেন জেনে গেছি, ওই ফুল বিষাক্ত। ধরা-ছোঁয়া যাবে না।

খালের পাড়ে এবং পুকুর ও ডোবার জঙ্গল পরিবেষ্টিত অংশে আপনা থেকেই জন্মাত নলখাগড়া। কাশের (খাউল্যা) বড় ভাইয়ের মতো দেখতে নলখাগড়ার মাথায় এক ঝাঁক ধূসর সাদা ফুল। এক সময় ফুলগুলো জমে গিয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়। মনে হয়, তাজা নলখাগড়াগুলোর মাথায় আবর্জনার ঝুঁটি।

জঙ্গলের ভেতরে তখন সেজেগুজে বসে আছে নতুন বউ। কামরাঙার মতো কুড়ি থেকে মিষ্টি খয়েরি রঙের ফুল ফুটিয়েছে উলটকম্বল। তার মাথায় হৃদয়ের ডিজাইন করা বিশাল পাতার ঘুমটা। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য তার! দেখার মতো কেউ নেই। মুগ্ধ হওয়ার মতো কেউ নেই। এমন কি তার দেহ থেকে ফুল তুলে নেওয়ার কষ্টটুকু দেওয়ার লোকও নেই কোথাও।

আর বর্ষায় জেগে থাকা জমিটুকু কোথায়ও কি খালি থাকে? একদম না। বিচিত্র রঙের ঘাসফুলে ভরে উঠে বর্ষায় জেগে থাকা জমিনের শরীর।

আর বাড়িতে? গৃহস্থ বাড়িতে তখন ঝিঙে ফুল আর কুমরা ফুলের রাজত্ব। ঝিঙে ফুল যারা দেখেনি তাদের কথা বাদ। যারা একটি ঝিঙে ফুল দেখেছে তাদের কথাও বাদ। ঝিঙে ফুল দেখতে হবে ঝিঙের ঝোপে, ঘরের চালে, ছাউনিতে। এক সঙ্গে অসংখ্য ফুল যখন ফুটে ওঠে তখন পৃথিবীর সব রূপ যেন কোলাহল করে ওঠে ওই নির্জনতার মধ্যে। `ঝিঙে ফুল` নামে কবিতা লিখেছেন কবি নজরুল ইসলাম। ওই কবিতা পড়ার সময় আমাদের টেবিলে ঝিঙে ফুল থাকতেই হবে। কিন্তু ওই কথাটা কিছুতে বুঝতাম না "ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল"। ফিরোজিয়া তো রঙেরে নাম। কিন্তু "ফিঙে-কুল" কী? ফিঙে নামক ঝগড়াটে পাখিটার গায়ের রঙ তো কালো। তা হলে কী হলো? বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও বলেছিল "কবিতার মধ্যে অত অর্থফর্ত থাকার দরকার নাই। পইড়া যা।" আসলে সেও পারে না।

ফিরোজা রঙের বিপুল পাতার সমারোহের মধ্যে অসংখ্য হলুদ ঝিঙে ফুলের আলতো করে ফুটে থাকা যারা দেখেছে তাদের জীবনে ওই একটা দেখা বটে। হলুদ বললাম বটে, কিন্তু এ যে কী রঙের হলুদ তা বলে বোঝানো যাবে না। আপনি বলতে পারেন আলো মাখানো হলুদ। হবে। কেউ বলবে জ্যোৎস্না মাখানো হলুদ। তাও হবে। আবার অন্যে যদি বলে আবির মাখানো হলুদ, সেটাও বেঠিক হবে না। তার মধ্যে যদি বাতাসের মৃদু কম্পনে ফুলগুলো কাঁপতে থাকে তা হলে আপনার শিহরণের শেষ থাকবেন না এবং ওই হলুদ রং যে কী রূপ ধারণ করবে তার কোনো ভাষা থাকবে না।

মায়ের হাতে বানানো কুমরা ফুলের ভর্তা খেয়েছি বহুবার। চিংড়ি মাছের ভর্তার মতো স্বাদ নিশ্চয়ই নয়। তবুও মায়ের হাতে বানানো বলেই বেরসিকের মতো আগে মনে পড়ল ভর্তা খাওয়া কথা। ওই শ্রাবণ-ভাদ্রেই ফুটত কুমরা ফুল। চাল কুমরা বা জালি কুমরার কথা বলছি না। এ হলো মিষ্টি কুমরা। ডাটের উপরে চোঙার মতো পাঁপড়ি ঘিরে হলুদ রঙের এই ফুল গ্রামের সব বাড়িতে এবং কোলাকাঞ্চায় ফুটত। শৈশবে দেখেছি, ফুলের মর্যাদা এদের নেই। অথচ তাদের কাছে গেন্দা মানে গাঁদা ফুল, গোলাপ অবশ্যই ফুল, জবাও ফুল এমনকি নয়নতারাও ফুল কিন্তু কুমরাফুল ফুল নয়, জিঙেফুল ফুল নয়। আর কলমি ফুল, পানা ফুল, হেলেঞ্চা ফুল, পাট ফুল, ধঞ্চা ফুল কোন ছার। যত্তসব।

ফুল সম্পর্কিত ধারণার যে আর্কেটাইপ আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে তার ইতিহাস কী? কীভাবে হলো? কারা করলো? কখন করল? আমার খুব অবাক লাগে। অথচ যখন দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি তখন এই ধারণাও তৈরি হয়নি যে, কলমি ফুল ফুল নয়, পানা ফুল ফুল নয়, হেলেঞ্চা ফুল ফুল নয় , পাট ফুল ফুল নয়, ধঞ্চা ফুল ফুল নয়। সুতরাং তখন এইসব ফুল আমাদের কাছে ছিল মহার্ঘ্য। আমরা ফুল তুলতাম, জোড়াতালি দিয়ে মালা গাঁথতাম, হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম এবং বোনেরা চাইলে খুবই কৃতার্থ হয়ে তাদের হাতে ফুল তুলে দিতাম। এক আপু ফুল নিয়ে বলেছিল, "ফুল তো দিলি, এখন তো তোর লগে আমার ভালোবাসা অইয়া গেল। আমারে এখন তোর বিয়া করন লাগব। তুই বিয়া না করলে আমারে কেউ বিয়া করব না, বুঝলি।" আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। বললাম, “তয় আমার ফুল আমারে দিয়া দেন।” আপু বলল, “এখন নিলেও অইব না। আমাকে তোর বিয়া করতেই অইব।” আমি মহা বিপদের আশঙ্কায় ওই যে দৌড়ে পালালাম আর পারতপক্ষে আপুর মুখোমুখি হইনি। আপু একদিন আমাকে খপ করে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “আমারে আর তোর বিয়া করতে অইব না। ফুল হুগাইয়া গেছে। ভালোবাসা শেষ।” আমি ফিক্ করে হাসি দিয়ে আপুর কোল থেকে নেমে দৌড় দিলাম। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ