আবু তাহের সরফরাজে

আবু তাহের সরফরাজে

সরফরাজের ইসলামি গান শিল্পচেতনার নতুন দ্যোতনা

কাজী নাসির মামুন

প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০২০

ছাড়পত্রে ৩ নভেম্বর প্রকাশিত হয় আবু তাহের সরফরাজের দশটি ইসলামি গান। প্রকাশের সাথে সাথে গানগুলো পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। নজরুলের হাতে একটা সময়ে এ দেশে ইসলামি গানের যে জোয়ার এসেছিল, পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। এখন ইসলামি গানের চর্চাটি মাদরাসার হুজুরদের হাতে চলে গেছে। সস্তা কথার ঝকমারিতে সেখানে মেধার কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। এরই পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত সমাজ ইসলামের নামে নাক সিটকোয়। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিশেবে ইসলামি রীতিনীতিকে তারা মানতে নারাজ। এ অবস্থায় মূলধারার কোনো কবি ইসলামি গানের চর্চায় এগিয়ে আসেন না। কিন্তু আবু তাহের সরফরাজ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে গান লিখতে এগিয়ে এসেছেন। তার দশটি গান পড়ে গানের নিচে কবি কাজী নাসির মামুন একটি মন্তব্য করেছেন, যা তাৎপর্যপূর্ণ। তার মন্তব্যটি তুলে ধরা হলো— ছাড়পত্র ডেস্ক

আবু তাহের সরফরাজের ইসলামি গানগুলো পড়লাম। মন্তব্য করতে গেলে একটু বড় হয়ে যায় কিনা, ভাবছি। সরফরাজের সঙ্গে আমার জানাশোনাও অনেকদিনের। তার পাঠাভ্যাস ঈর্ষণীয়। হঠাৎ তিনি ইসলামি সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকলেন কেনো, ব্যাপারটা আমার জন্য কৌতূহলোদ্দীপক। আমি নিজেও ধর্মীয় স্টাডি করি। সেই স্টাডি কেবল ধর্মীয় দর্শনকেন্দ্রিক। তাই ইসলামি সঙ্গীতের কথা কখনো ভাবিনি। আল্লাহপ্রেম বা নবিপ্রেমের জায়গা থেকে এসব গানের ধর্মীয় মূল্য থাকলেও শিল্প-মূল্যের কথা কেউ ভাবতে চায় না। বরং নানা রকম ট্যাগ লাগিয়ে গীতিকার কিংবা কবিকে বিপর্যস্ত করে তোলে অনেকেই। এসব তোয়াক্কা না করে ভক্তির মাধুরি মিশিয়ে এই যে তার সঙ্গীতের প্রণোদনা, একে সাহসী পদক্ষেপ বলা যায়।

সাহসী পদক্ষেপই, কেননা কবিতায় ইসলামি শব্দ ব্যবহারই যেখানে সমালোচিত হয়, কবিকে সেক্ষেত্রে মূল ধারায় বিবেচনা না করে ভাবা হয় `আদার`, সেখানে সরাসরি ইসলামি সঙ্গীতে আত্মনিয়োগ মানে বিরাট এক মানসিক শক্তির ব্যাপার। ফলে আবু তাহের সরফরাজ ইসলামি সঙ্গীত লেখার মাধ্যমে নিজের সাহিত্যিক কেরিয়ারকে রিস্কি করে তুলেছেন বা নিজের ধর্মবোধের তাড়নাকে শিল্পের ওপরে স্থান দিয়েছেন, কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারে। কেননা আমাদের শিল্পবোধ আধুনিকতার একটা আরোপিত ধারণার বশবর্তী। যেখান থেকে মুক্ত ছিলেন না ড. হুমায়ুন আজাদও। কাজী নজরুল ইসলামের `মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই` গানটিকে নিয়ে `আমার অবিশ্বাস` গ্রন্থে অত্যন্ত রূঢ় এবং তিরস্কারমূলক সমালোচনা করেছেন তিনি। অথচ নজরুল যে ভক্তিমূলক শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন, এ নিয়ে তার বৈরী কথাবার্তা কখনো শুনিনি আমরা। এর কারণ অবশ্য অনেক গভীরে।

সংখ্যায় গুরুস্থানীয় হলেও আইডিওলজিক্যাল বা বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় মুসলিম মানস কিংবা ইসলামি থটকে সংখ্যালঘু প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা আছে। সেক্ষেত্রে আবু তাহের সরফরাজের ইসলামি সঙ্গীত স্ফূর্ত হয়ে উঠলে `আধুনিকতা` বর্জিত মুসলমানদের জন্য আশাবাদী হবার কারণ আছে। মৌলিক দৃষ্টিতে তাকালে এই `অনাধুনিক` জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছতে পারার সক্ষমতাই আমাদের শিল্পচেতনার নতুন দ্যোতনা এনে দিতে পারে। সেটা এই ইসলামি সঙ্গীত দিয়ে কতটা সামগ্রিকভাবে পারবেন এই কবি, আমি জানি না। তবে নজরুলের পর ইসলামি সঙ্গীতের যে বেহাল দশা তাতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলে অবশ্যই আশার কথা। অনেকেই এ ব্যাপারে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নতুন প্রচেষ্টায় যুক্ত হলেন আবু তাহের সরফরাজ।

ভক্তিমূলক ইসলামি সঙ্গীত মাদ্রাসা ছাত্রদের এক পাক্ষিক চর্চার বিষয় নয়। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সঙ্গীতের নিম্নগুণ প্রায় অরুচিকর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অনেক ধুম-ধারাক্কা হিন্দি ও বাংলা সিনেমার গানের সুরকে নকল করে অগভীর কিছু ধর্মীয় কথা বসিয়ে তাকেই ইসলামি সঙ্গীত হিসেবে চালানোর একটা বাজে প্র্যাকটিস চালু হয়েছে। সেই পথ বন্ধ করতে মেধাবীদের বরং এগিয়ে আসাই উচিত। সরফরাজ তার গানে শুধু ভক্তিতে গদগদ নন, চিত্রকল্পের সৌন্দর্যে মোহিত করবার বাসনা তার ক্ষীণ, বক্তব্যধর্মী এসব গানে রয়েছে আত্মসমালোচনা। `আত্ম` এখানে গোটা মুসলিম সমাজের প্রতিভূ। তাই মুসলিম সমাজের আত্মশুদ্ধিও এই গানগুলোর লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই ভক্তির বাইরেও সমাজের দিকে তার দৃষ্টি ক্রিটিক্যাল।

ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক চৈতন্য এবং মরমীবাদের সংমিশ্রণে তার গান শুধু মুসলমানদের নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার হয়ে উঠবে একদিন, এই প্রত্যাশা করি। যদি সেই প্রত্যাশা পূরণ নাও হয়, তবু এই গানগুলো তাকে আত্মিক প্রশান্তি দিলে শিল্পিত ইচ্ছার চাইতেও বড় ইমপ্যাক্ট তৈরি হলো বলে মনে করি। নিজেকে আনন্দ দেওয়া ছাড়া কবি আর কি-ই বা করেন!

লেখক: কবি