সহজ কাজ যায় না করা সহজে

সাদিকুল রহমান খান

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২০

ছোটবেলায় চাষি আর চাষি বউয়ের গল্প শুনেছিলাম। চাষি সারাদিন মাঠে কাজ করতো আর বউকে এসে খোঁটা দিতো, তুমি তো সারাদিন বসে বসেই খাও। কয়টা কাজ আর করো? ওসব কোনো কাজ হলো?

লেগে গেল ঝগড়া। ফলাফল? কাজ ভাগাভাগি, চাষির বউ সফলভাবে মাঠের কাজ শেষ করে এলো, চাষি কিন্তু পারলো না ঘরের সহজ কাজটা করতে। কেন? কারণ সহজ কাজ যায় না করা সহজে!

চাষির গল্পের সাথে বাংলাদেশের নারীদের মিল কোথায় জানেন? বলছি। একটা বড় সময় ধরেই নারীদের এই খোটাটা সহ্য করতে হয়েছে। থাকো তো সারাদিন ঘরে বসে, এই যে ঘরের কাজকে আজকে নারীরাও আর সম্মানের চোখে দেখছে না, নিজেকে ঝি-চাকরানি মনে করছে, এর দায় কি পুরুষের না? পুরুষ যদি প্রথম থেকেই নারীর এই পরিশ্রমকে মূল্য দিতো, সম্মান করতো, অবদানটুকু স্বীকার করতো আর ঝি-চাকরের সাথে তুলনা না করতো— তাহলে নারীরাও আজ তাদের কাজটুকুকে অসম্মানের চোখে দেখত না।

টাকা ইনকামের সাথে সম্মানের যোগসূত্র আবিষ্কার কে করেছে? নারী নাকি পুরুষ? ‘আমি কি তোর কামাই খাই যে, তোর কথা শুনতে হবে?’ এই খোঁটাটুকুই যথেষ্ট ছিল নারীকে বাইরে বের করে নিয়ে আসার জন্য। যখন তারা আবিষ্কার করেছে, টাকা ইনকাম না করার অপরাধে পরিবার তাদের ন্যূনতম মর্যাদা বা সম্মান দেয় না, তাদের মতামতের মূল্য দেয়া হয় না, তাদের মানুষই মনে না করে বরং পোষা প্রাণীর মতো ট্রিট করা হয়, তখন তারা বাধ্য হয়েই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই বাইরে আসাটা নিছক টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে ছিলো না, এই বাইরে আসাটা আমাদের তৈরি করা টাকার স্ট্যান্ডার্ডে মানুষ হওয়ার জন্য।

যদি টাকা ইনকাম না করেই একটা মেয়ের যথাযোগ্য মর্যাদা, সম্মানটুকু আমরা দিতে পারতাম, তবে মেয়েদের বাইরে আসার প্রয়োজনই পড়তো না। যদি ছেলে বুড়ো বয়সে মাকে কিংবা স্বামীদের একটা বড় অংশ বিন্দুমাত্র ইনসাফ না করে বউকে ফেলে পালিয়ে না যেত, তাহলে নারীদের মধ্যে এই নিরাপত্তাহীনতাটুকুও তৈরি হতো না। আজ দেশের নারী কর্মজীবীদের দেখে যারা ধর্ম গেল ধর্ম গেল রব তুলেন, লাখ লাখ বৃদ্ধা মহিলা ভিক্ষুক দেখে আপনাদের পৌরুষ জাগে না কেন ভাই? ইসলামে চাকরি করা জায়েজ নাকি নাজায়েজ, এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ তখনই হতো যখন আমরা একটা ইসলামি সমাজে বাস করতাম। যখন একজন বৃদ্ধা, বিধবা ও ডিভোর্সিসহ সকল ধরনের নারীর আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা সমাজ এবং রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারতো।

যে সমাজে এখনও যৌতুকের ওজনে মেয়ে কেনাবেচা হয়, যে সমাজ তিনশো বছর ধরে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর জান্নাত টাইপের ভুয়া হাদিস সরবরাহ করে নারীকে সবসময় নিজের পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে চায়, যে সমাজে মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা পর্যন্ত টাকার লেভেলের সাথে উপর নিচে উঠানামা করে, সেই সমাজে ইসলামে নারীর অধিকার শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করে পাঠের আনন্দ পাওয়া যেতে পারে, এছাড়া আর কিছুই হবে না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, মুখে এইসব কথাবার্তার তুবড়ি ছুটিয়ে শেষমেশ ঐ উপমহাদেশীয় পুরুষতন্ত্রের সংবিধান মেনে পরিবার শাসন করবেন— এই ভণ্ডামি আর কতদিন কে সহ্য করে, বলুন?

আমার কেন জানি মনে হয়, এই যে নারীর চাকরির ব্যাপারটা, এখানে মূল প্রশ্নটা ইসলামের না। মূল প্রশ্নটা ইসলামের হলে আজ বাংলার অধিকাংশ নারী হতো জ্ঞানে গুণে হতো অনন্য। ইসলামপ্রেমী স্বামীদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতায় তারা কুরআন শিখতো, হাদিস শিখতো, ফিকহ শিখতো, সাহিত্য শিখতো, বিজ্ঞান শিখতো। এই সুযোগটা বাংলাদেশে স্বামীরা দেয় নাই কখনোই। তারা ইসলামকে ইউজ করেছে, প্রয়োগ করে নাই। ফলাফল? আজ ঘরে ঘরে ভারতীয় সিরিয়ালের বীণ বাজে, মেয়েরা দৌড়ায় বিউটি পার্লারে, দোষ কার? এগুলো নিয়ে ইসলামপ্রিয় পুরুষ সমাজের কিন্তু কোনো সমস্যা নাই, কোনো আপত্তি উঠে নাই।

প্রশ্নটা ইসলামের না। প্রশ্নটা যদি ইসলামেরই হতো, তাহলে এদেশের বেশিরভাগ নারীই শুদ্ধ করে কুরআন পড়তে পারে না কেন? প্রশ্নটা যদি ইসলামেরই হতো, তাহলে এই দেশের বেশিরভাগ মেয়েরই ইসলামের জ্ঞান এত কম থাকতো? প্রশ্নটা যদি ইসলামেরই হতো, তবে এখনও এই দেশের বেশিরভাগ ঘরে ঘরে হিন্দি সিরিয়ালের বজ্রপাত কেন? প্রশ্নটা যদি ইসলামেরই হতো, তবে চাকরি করতে বাইরে যেতে দিতে সমস্যা, কিন্তু দিনে দশবার মার্কেট আর পার্লারে যেতে দিতে সমস্যা হলো না কেন? প্রশ্নটা মার্কেটে যাওয়ারও না। কিন্তু সেই মার্কেটে নারী নিজের টাকা নিয়ে যাবে নাকি আপনার টাকা নিয়ে যাবে, প্রশ্নটা সেখানেই।

কারণটা ইসলাম না, কারণটা হলো কন্ট্রোল। প্রশ্নটা নিজেদের পৌরুষের তথাকথিত ইগোর, নিজের অবলা বউকে ‘আমি তোর কামাই খাই নাকি যে, তোর কথা শুনতে হবে?’ এই খোঁটা দেয়ার আনলিমিটেড অধিকার চাওয়ার মধ্যে মিথ্যে পৌরুষের গৌরব। মেয়েদেরকে বরাবরই উপমহাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটা কন্ট্রোল টুল হিসেবে দেখেছে, এর বেশি কিছু না। এ দেশের পুরুষরা কখনোই একজন ইসলাম জানা নারীও চাননি, ইসলামি জীবনও চাননি, আপনারা বরাবরই চেয়েছেন নারী নামের অজ্ঞ এবং মূর্খ এক বস্তা আটা ময়দার স্তূপ, যাকে দিয়ে ইচ্ছামতো রুটি বানিয়ে খাওয়া যাবে, বেচাল হলেই স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর জান্নাত টাইপের ভুয়া হাদিস লিখে পায়ের কাছে রেখে দেয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথের তোতা পাখির মতো যারা আপনার ন্যায় অন্যায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেই সবকিছু মেনে নেবে, সারাজীবন আপনি তাকে দাবিয়ে রেখে দেবেন।

শুধু চাকরি না, নারীর জ্ঞানার্জনকেও আপনারা ভালো চোখে দেখেননি। যারাই একটু পড়তে চেয়েছে, একটু ব্যতিক্রম চিন্তা নিয়ে লিখতে চেয়েছে, তাদেরকেই ইসলামি ফেমিনিস্ট ট্যাগ দিয়ে বসিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। কোনো পুরুষ যখনই এসব নিয়ে ব্যতিক্রমী চিন্তা করতে গেছে, তাকেও আপনারা মডারেট ট্যাগ দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন। এই যে অবিশ্বাসের একেকটা ইট, নারীর প্রতি বেইনসাফির একেকটা লুপহোল, এই ইট দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে পশ্চিমা পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদের প্রাসাদ, ঐ লুপহোল দিয়েই ঢুকে পড়ছে পশ্চিমা লিবারেলিজমের ভয়ঙ্কর স্রোত। এই স্রোত গায়ের জোরে বা ফতোয়ার জোরে থামাতে পারবেন না ভাই। ওই পশ্চিমা নারীবাদকে ফেইস করতে হলে উপমহাদেশীয় ফ্লেভারের পুরুষ জমিদার সুলভ মানসিকতা ফেলে দিন। প্রকৃত ইসলাম, প্রকৃত ইনসাফ নিয়ে নারীর চ্যালেঞ্জকে দেখতে চেষ্টা করুন। তাদের সাথে ইনসাফ করুন, তাদের সহযোগিতা করুন, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের দাবি তুলুন। তাদেরকে যুগের পর যুগ ধরে সম্পত্তির ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার আচরণ থেকে বেরিয়ে আসুন।

মা, বোন কিংবা স্ত্রী হিসেবে ইসলাম তাদের যতগুলো মর্যাদা দিয়েছে, সব খুশি মনে দিয়ে দিন, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মিথ্যা ইগো ফেলে দিয়ে প্রতিযোগি না হয়ে সহযোগিতা আর বিশ্বাসের শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলেন, দেখবেন, পশ্চিমের ভ্রান্ত নারীবাদ পালাবার পথ পাবে না। যুগ যুগ ধরে যে অবিশ্বাসের পাহাড় আমরা পুরুষেরা গড়ে তুলেছি, সেটা ভাঙার উদ্যোগও আমাদেরই নিতে হবে।