ফটো সাংবাদিক রেহেনা আক্তার

ফটো সাংবাদিক রেহেনা আক্তার

সাংবাদিকতা আসলে মাদকের চেয়েও বাজে নেশা

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২০

মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে চলে যাওয়া মেনে নিতে হয়। রেহানা আর আমি একই সংগঠন করে আসা। যদিও আমি সেভাবে ওর পাশে কোনোদিন দাঁড়াতে পারি নি। পারি নি বললে ভুল, আসলে সেই সদিচ্ছা আমার ছিল না। আমাদের কারোরই হয়তো ছিল না। তাই, সময়মতো চিকিৎসা না পেয়েই ওর এই প্রস্থান। ওর মৃত্যুতে শোক করা আমার সাজে না, বরং আমি লজ্জিত।
 
বাংলাদেশে আমার মতো প্রতিটি সাধারণ সাংবাদিকের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি রেহানার মতোই। আমরা অন্যের সমস্যা নিয়ে লিখি, কিন্তু নিজেদের সমস্যা, আমাদের প্রতি অন্যায় বা আমরা চাকুরে হিসেবে যে বঞ্চনার শিকার হই, তা কোনোদিন লিখতে পারি না।
 
সংবাদপত্র মালিকরা পরস্পর পরস্পরকে অপছন্দ করলেও এই এক জায়গায় তারা একতা বজায় রাখেন। বঞ্চনার শিকার সাংবাদিক একবার মুখ খুললেই সবার দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আমরা এক জায়গা থেকে গলা ধাক্কা খেয়ে মুখ বন্ধ করে আরেক জায়গায় ঢুকার চেষ্টা করে যাই আজীবন।
 
একটা ছেঁড়া টাকার আত্মজীবনী লেখা হয় কিন্তু একজন জীবিত সাংবাদিকের আত্মজীবনী, তার আত্মগ্লানির কথা কোনোদিনও কোথাও লেখা থাকে না। দিনের পর দিন অপমানের স্তূপ মাথায় নিয়ে আমরা লিখি পোশাকশ্রমিক বা আরো অন্য পেশার মানুষের সাথে হওয়া অন্যায়ের গল্প। একেই বলে আইরোনি।

প্রায় চোদ্দ বছর টানা সাংবাদিকতা করে এই একটাই গভীর উপলব্ধি হয়েছে। অপমানিত হয়েছি বহুবার, পদে পদে। কিন্তু বলতে পারি নি। একবার মুখ খুললেই আর কোথাও জায়গা হবে না আমার। পনের দিন আগে ভাবলাম, অনেক তো হলো। এবার এসব ছেড়ে দি। সাহিত্যে মন দি। নিজের সাহিত্য পত্রিকাটা সমৃদ্ধ করি। বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন হলো, টিভিতে বড় কোনো সংবাদ চোখে পড়লেই নিজের অজান্তে ল্যাপটপের পাশে ঘোরাঘুরি করি। সাংবাদিকতা আসলে পেশার চেয়ে বড় নেশা। মাদকের চেয়েও বাজে নেশা।
 
এই নেশাতে একবার পেলে আর নিস্তার নাই। তাই, নিজের বঞ্চনার গল্প আমিও চেপে যাব। মুখ বন্ধ করে আবার হয়তো কোনো বড় পত্রিকায় ঢুকে যাব আর দিনশেষে অন্যের জন্য লিখে যাব শোকগাথা। আমার নিজের জন্য বিলাপ করা আমার আর হয়ে উঠবে না কখনোই।
 
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী