সাঈদ ইসলামের গদ্য ‘সাম্রাজ্য বিজয় নাকি জ্ঞানের চর্চা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২১

ইসলামিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের শার্প টার্ন হিসেবে অষ্টম শতকের সূচনাকে বিবেচনা করা যায়। একটু পেছনে তাকালে আব্বাসিয় যুগকে ধরা যায় তার আঁতুর ঘর। মূলত আরব-অনারবের মধ্যকার পার্থক্য উধাও হয়ে পারস্যের আমলারা সাম্রাজ্য পরিচালনার সুযোগ পেতে থাকে এই সময়ে। সাম্রাজ্য পরিচালনার বিশাল অভিজ্ঞতা ছিল তাদের ঐতিহ্যের অংশ। পারসিয়রা চালু করতে সক্ষম হয় একটি জটিল আমলাতান্ত্রিক রাজ্য পরিচালনা নীতি।

এশিয়ার এদিকটায়, অর্থাৎ ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ বিন কাশিম। সালের হিসেবে সময়টা ছিল ৭১১ সন। অন্যদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারে নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তারিক বিন যিয়াদ। তিনি জয় করেছিলেন স্পেনের ভূমি। একদিকে এশিয়ায়, অন্যদিকে ইউরোপে ছড়িয়ে যায় আরবের (আরব শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও যাযাবর অর্থই পাওয়া যায়) যাযাবরদের ইসলাম! এখানে বলে রাখা ভালো, অনেকেরই ধারণা, এশিয়ায় ইসলামের আগমনে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিল এই অঞ্চলের নিচু জাতের হিন্দুরা। ধারণাটি সর্বাংশে ভুল। ভারতে ইসলাম আগমনের প্রাথমিক যুগে বেশিরভাগ ধর্মান্তরিতরাই ছিল বৌদ্ধ। এমনকি বাংলা ভাষার চর্চা ও সমৃদ্ধির বিচারে বৌদ্ধ জাতির কাছেই আমাদের ঋণী থাকতে হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলিমদের সামনে আসে এক নতুন সমস্যা। নব্য জয় লাভ করা অঞ্চলগুলোর কোথাও কোথাও এমনকি মুসলিমদের সংখ্যা ছিল দশ ভাগেরও কম (জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরিত করার পথে বিজয়ীরা হাঁটেনি)। এর ফলে ব্যাপক সমস্যা দেখা দেয় কর সংগ্রহ নীতিকে কেন্দ্র করে। ভারতে ইসলাম আগমনের চল্লিশ বছর পর (৭৫০ সন) ক্ষমতা নিয়ে উমাইয়া ও আব্বাসিয়দের যুদ্ধের অবসান ঘটে। মেসোপটেমিয়ায় জাবের যুদ্ধে উমাইয়ারা পরাজিত হয় এবং আব্বাসিয়রা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় একক আধিপত্য। বহু স্কলার এই সময় থেকে চলে আসা শাসনকালকে আর ইসলামিক শাসনকাল হিসেবে বিবেচনা না করে রাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্য বিস্তার বলেই ধরে নেন। যদিও এর কিছুকাল আগে থেকেই মুসলিমরা নতুন করে আর কখনোই সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। ৭৩২ সালে ট্যুরের যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলিমদের ইউরোপ বিজয়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

ক্ষমতায় তখন দ্বিতীয় আব্বাসিয়  খলিফা আল মনসুর। ৭৬৫ সাল। মুসলিমরা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে আবিষ্কার করে এক ঊর্বর ক্রিসেন্ট। জন্ম নেয় ১০ লাখ মানুষের নতুন শহর বাগদাদ। দুই যুগের ব্যবধানে শহরটি হয়ে ওঠে মেট্রোপলিটান সিটি। এর কিছুকাল পরে, খলিফা আল মামুনের আমলে শুরু হয় মুসলিমদের নতুন যাত্রা। সাম্রাজ্য ও অঞ্চল জয়লাভ করা জাতি মনোযোগী হয় এককেন্দ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষার চর্চায়। বাগদাদ পায় ‘হাউজ অব উইজডম’র খেতাব। ধীরে ধীরে এখানে জমা হতে থাকে নানান দেশ ও সংস্কৃতির পণ্ডিতগণ। আসে গ্রীক, আরব, পার্সি ভারতীয় ও ইউরোপের স্কলাররা। তাহলে কি সূচনা হয় মুসলিমদের পরাজয়ের কাল? প্রচলিত মত বলে ভিন্ন কথা, সূচনা হয় মুসলিমদের সোনালি যুগ বা জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনার অত্যাশ্চর্য যুগের।

এখানেই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা যায়:
ক. সাম্রাজ্য বিস্তার না করে কোন জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে? যে কারণে সাম্রাজ্যবাদ খারাপ সেই কারণ ধরে না রাখলে, আমেরিকা কি আমেরিকা থাকে? সাম্রাজ্যবাদ খারাপ ধরে নিয়েও খাওয়ারিজমী, খৈয়াম, বাত্তানি, বিরুনি, মাজরিতি, বতুতা, আল ইদরিসি, আল মাসুদি, ইবনে সিনা, আল রাজি, হাইসামের জন্ম পৃথিবীকে যে আলো দিয়েছিল তা আর পরবর্তীতে কেন মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হলো না?

খ. সাম্রাজ্য বা শাসন বিস্তার না করলে জ্ঞান বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয় না, হয় কি?
গ. কেবল জ্ঞানের চর্চা পরবর্তী সময়ে নতুন জ্ঞানীদের আশ্রয় দানে ব্যর্থ হয়, তাই কি?
ঘ. একত্রে জ্ঞান বিস্তার ও সাম্রাজ্য বিস্তার না করা উন্নত জাতি কোনটি?  
ঙ. নতুন ভূমিহীন নতুন জ্ঞান ছড়ানো মূলত শক্তির অপচয় কি?
চ. রক্তপাতহীন বিপ্লবই যদি কাম্য হয়, তবে এনজিওবাদই কেন সেরা অপশন নয়?