সাজ্জাদুর রহমানের গদ্য ‘সাত সাগরের মাঝির গল্প’

প্রকাশিত : জুন ১০, ২০২২

দেশভাগ হলো। বাংলাও দুইভাগে বিভক্ত হলো। কোনো জাতি বা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয় তার সাহিত্যিকরা। সাহিত্য আয়নাস্বরূপ। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, ‘কোনো দেশে ভ্রমণে গেলে প্রথমে তার বাজার ও লাইব্রেরি দেখতে হবে’। তেমনই কোনো সময়, ইতিহাস কিংবা জাতি সম্পর্কে জানতে হলে সাহিত্যিকদের ঘাঁটা প্রয়োজন।

ভাগকৃত এপার বাংলা তাই ওপার বাংলার সাহিত্যের ভাষায় চলতে পারত না। প্রয়োজন ছিল নিজস্ব সাহিত্যিক ভাষা, উপমা, কৃষ্টি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির। সে ভাবনা থেকেই হঠাৎ করেই পালটে গেল বাংলাদেশের সাহিত্যিক পরিভাষা। সাহিত্যে বৃদ্ধি পেল আরবি, উর্দু ও ফারসি শব্দের ব্যবহার। ইসলামি চেতনা সবার লেখায় প্রকাশ না পেলেও ইসলামি সংস্কৃতির পরিচায়ক অনেক কিছুই আলোচিত হতো সেসব সাহিত্যে।

অবশ্য এ কাজটি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগে থেকেই করতেন। তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। পাহাড় কেটে পাথর সরিয়ে পথ বানিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করবার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সাহিত্যের মাঠে নতুন কিছু চারা রোপণ করেছিলেন। চারাগুলো উদ্ভিদ হলো। মাটির গভীরে শিকড় প্রোত্থিত করে চির ভাস্বর হয়ে অনুপ্রেরণা দিল আরো কিছু মানুষকে এগিয়ে আসবার। তারা এগিয়ে এলেন, উদ্ভিদের ডালপালায় চড়ে পাতাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন এখান থেকে সেখানে। যেন বসন্তের বাতাসে উড়ে যাওয়া কোনো কায়াহীন পাখির মতো। বাধাহীন এই উড়তে চাওয়ার মাধ্যমেই জন্ম নিল আরো কিছু প্রতিভাবান। ফররুখ আহমদকে তাদের সাথে একাঙ্গীত করা যাবে না, তিনি অনন্য ছিলেন, স্বমহিমাতেই উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।

আল্লামা ইকবালের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তার উত্থান হলো। নৃশংসতা, বিভীষিকা ও অত্যাচার দেখে আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রে। অচিরেই ভুল ভাঙল, সমাজতন্ত্রের অসারতা দীপ্তিময় হলো তার চোখে। মানবতায় বিশ্বাসী হলেন। মানবতা লালন করতে গিয়ে ইসলামকে খুঁজে পেলেন আশার তরী হিসেবে। সাত সাগরের পাড়ের মাঝি থেকে দরিয়ার পাঞ্জেরী হয়ে সমুদ্রে ওড়ালেন তার জাহাজের পাল। মাঝে দ্বীপ নির্মাণ করে সিন্দাবাদের সাথে তাল মিলিয়ে মানবতার লাশকে বাঁচানোর তাগিদে হাতেম তায়ীর শরণাপন্ন হলেন। এই আমাদের কবি ফররুখ আহমদ। ইসলামি রেনেসাঁর কবি, মানবতার কবি।

১৯৪৭ সাল। দেশভাগের পর সওগাত পত্রিকায় দৃপ্ত কণ্ঠে কলমের ঘায়ে আওয়াজ তুললেন মাতৃভাষা বাংলার। পূর্বে জনসংখ্যা বেশি, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা মাতৃভাষা হবে না তো কাদের হবে? ১৯৪৮ সালে চাকরি পেলেন বেতারে। বায়ান্নর আগুনঝরা দিনে শুধু কলম নয় রাস্তায় নেমে দাঁড়ালেন বেতারের সহকর্মীদের নিয়ে। ভাষা আন্দোলনে গান, কবিতা দিয়েই নয় তার সম্মুখ অংশগ্রহণও ছিল। সেটা ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। আইয়ুব খান থেকে ঘোষিত হওয়া তার প্রাইড অব পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ডও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একজন কবির ক্ষমতাদর্পীর হাত থেকে নেয়ার কিছুই নেই।

আদর্শের প্রশ্নে কোনোকিছুর সাথেই তিনি আপস রফায় যাননি। তার কবিতার দর্শন কি ছিল? কবিকে নিয়ে আমাদের সমাজে এক ধরনের চর্চাহীনতা আছে। তার কবিতায় আরবি ও ফারসি শব্দের ব্যবহার, ইসলামি ভাবধারার কবিতা হবার কারণে এক শ্রেণির লোকের কাছে তিনি নিগ্রহের শিকার। এখানে কিছু কথা অবশ্যই বলার আছে। কোনো লেখা, সাহিত্যকর্মকে যখন আমরা বিশ্লেষণের জন্য বিবেচনা করব, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, রচনা সময়কালের প্রেক্ষাপট কি ছিল, ইতিহাস কি ছিল। একই কথা ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রেক্ষাপট ছাড়া সবকিছুই যদি বর্তমানের চোখে বিচার করা হয়, তবে সেটা সাহিত্যকর্ম কিংবা আইডিওলজির প্রতি অবিচার। ফররুখ আহমদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা বোধহয় বেশিই ঘটে। তার সাহিত্যকর্ম বিবেচনায় তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, মানুষমানস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় রাখতেই হবে।

তার কবিতাগুলোকে আমরা কেনই বা মনে রাখব? ফররুখ কি কেবলি ইসলামি ভাবধারার রচনাই লিখেছেন? অবশ্যই না। শিশুদের নিয়ে তার দুর্দান্ত কার্যভাণ্ডার রয়েছে। সাম্প্রতিক এসব প্রকাশিতও হয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। বর্তমানের বহুল প্রচলিত শিশুতোষ সাহিত্যগুলো যখন শিশুদেরকে নৈতিকতা বিবর্জিত, আদর্শত্যাগী এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন নিছক বিনোদনে অভ্যস্ত করাচ্ছে, তখন তার রেখে যাওয়া কাজগুলো আমাদের প্রজন্মের সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। আমাদের ও আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে এসব অবশ্যই মৌলিক ভূমিকা রাখবে যদি আমরা সত্যিই চাই কবি ফররুখের কাজের মূল্যায়ন।

তার কবিতায় ভাষার যে ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় তা অনিন্দ্য। বিশেষ করে পাঞ্জেরী ও সিন্দবাদ কবিতা দুটোতে ভাষাব্যঞ্জনায় জাগরণের ডাক যে কাউকেই মুগ্ধ করতে বাধ্য। শব্দের জালে অনুভূতির মূর্ছনায় জেগে রেনেসাঁর যে আহবান তিনি করেছেন তাতো এই বাংলার জনগণের জন্য সবসময়ই প্রাসঙ্গিক ছিল। ইতিহাস তাই বলে আলেকজান্ডারও গঙ্গাঋদ্ধি থেকে লাগাম ঘুরিয়েছিলেন। নৌফেল ও হাতেমের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি সুলতানী আমলের মুসলিম বাংলা সাহিত্য কিরকম ছিল তার কিয়দংশের স্বাদ। সিরাজাম মুনীরা আমাদের দাঁড় করিয়েছে একঝাঁক শ্রেষ্ঠ মানুষদের সম্মুখে। এসব বইতে একটা জিনিস খুব দৃঢ়ভাবেই উপস্থিত আছে। তিনি এসবে ফুটিয়ে তুলেছেন ইসলামী জীবনাদর্শকে। মানুষের জন্য সর্বোত্তম, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র নিয়ামক এবং সুশাসনের ভিত্তি হিসেবে ইসলামকে তিনি ধারণ করেছেন রচনাগুলোর মাধ্যমে। যা ছিল তার বিশ্বাস তার বাইরে গিয়ে তিনি কিছুই করেননি। যদি তিনি করতেন তাহলে হয়ত তার মূল্যায়ন ভিন্ন হত।

আহমদ ছফা বলে গিয়েছেন, অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক যাদের কোনো রকমের আদর্শবোধ নেই, চরিত্র নেই, সুবিধেটাই নীতি। ফররুখ আহমদের অপরাধ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায় যে, তিনি অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের মতো শ্লোগান বদল করতে পারেননি। সৎ কবিরা অনেক সময় ধরতাই বুলিতে গা ঢেলে দিতে পারেন না। সেটাই তাদের একমাত্র অপরাধ। কবি ফররুখ আহমদও এই একই অপরাধে অপরাধী। ফররুখ আহমদ একজন বীরচরিত্রের পুরুষ। একজন শক্তিমন্ত কবি।

তিনি এখানেই সবচেয়ে সুন্দর, সবার চেয়ে আলাদা আকাশে জ্বলজ্বল করা তারকার মতো। এখানে এটিও বলা যায়, তিনি ঐতিহ্যকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উৎকৃষ্টভাবে আমাদের সামনে এনেছেন। নজরুল, সিরাজী, গোলাম মোস্তফা ও কায়কোবাদদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে যার সূচনা হয়েছিল তার পতাকাই ফররুখ বয়ে চলেছিলেন তবে তিনি স্বাতন্ত্রতাও ধরে রেখেছিলেন। তার পূর্বেকার এই ধারার কবিদের দেখা যেত নজরুলকেই অনুসরণ করে লিখতে কিংবা তখন রবীন্দ্রনাথ এবং মধুসূদনও যথেষ্ট প্রভাবশালী। এসবের মাঝেও মুসলিম ঐতিহ্য এবং স্বাতন্ত্র্যবোধের ধারায় তিনি স্বকীয়তা জারি রেখেছিলেন। তার সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর পরিচয় বোধহয় এটাই যে তিনি, নিজ আদর্শ ও স্বীয় জাতিগত ঐতিহ্যে বিশ্বাসী একজন কবি।.

ইসলামি রেনেসাঁর কবি নামে পরিচিত এই প্রবাদ পুরুষের জন্মদিন আজই, ১০ জুন। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তর আলোচনা হোক এরচেয়ে বড় প্রার্থনা আজকের দিনে অন্যকিছু হতে পারে না। তার সাহিত্য আমাদের পথ দেখিয়েছিল, আমাদের সাহিত্যে তার ভাষা নতুন এক পথের সূচনা করেছিল। ইসলামি জাগরণমূলক কবিতাগুলো ছাড়াও তার রচনাভাণ্ডার কম সমৃদ্ধ নয়। সাহিত্যের আধুনিকতার বিচারে তার কাব্যের ভাষা, মাধুর্যতা ঈর্ষণীয়। মানবতার প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে কবির কলম ছুটে চলেছিল পরিপার্শ্বের ঘোর অমানিশা ভেদ করে, নতুন দিনের রাহবারদের হাতে সেই কলমেরই প্রত্যাশা।