সানোয়ার রাসেলের গদ্য ‘সময় এবং বদলে যাওয়ার কথকতা’

প্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০২১

সময় মহান সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য সৃষ্টি। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্তই বিশ্বনিয়ন্তার নিকট পরিজ্ঞাত; এই অর্থে তা একক, স্থির ও অখণ্ড। আবার রাতকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের পোশাক স্বরূপ; যেন সে ঘুমাতে পারে। ঘুমকে করা হয়েছে বিশ্রাম। দিবসকে সৃষ্টি করা হয়েছে জীবিকা অন্বেষণের জন্য। রাত্রি ছুঁতে পারে না দিবসকে, দিবসও প্রবেশ করতে পারে না রাত্রির ভেতর।

দিবা-রাত্রির এই কালচক্র নিয়ন্ত্রণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্য; যা আলোকের উৎস; যা দিবা-রাত্রিরও কারণ। ফলে মানুষ তার সীমাবদ্ধ আয়ুর ব্যাপ্তিতে অখণ্ড সময়কে খণ্ডে খণ্ডে, পলে পলে বিভাজিত করার সুযোগ পেয়েছে। তাই পরম প্রতিপালকের কাছে সময় অখণ্ড ও স্থির হলেও মানুষের কাছে তা নিয়ত ধাবমান। মানুষের কাছে এই মুহুর্তটি ঠিক যেমন; মুহুর্তকাল আগের মুহুর্তটি কখনই তেমন ছিল না আর মুহুর্তকাল পরের মুহুর্তটিও তেমন হবে না কখনই। এই জন্যই জ্ঞানীরা বলেন যে, এক নদীতে কখনও দুইবার সিনান করা যায় না। আমরা আমাদের সময় নামক নদীটিকে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ― তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছি।

অতীত আমাদের কাছে স্মৃতি― আমরা তা রোমন্থন করতে পারি। ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে এক কল্পনা― আমরা তা অনুমানের চেষ্টা করি। আর বর্তমান তো কেবল অতীতের ফল এবং ভবিষ্যতের ভিত্তি। আমাদের অতীত-স্মৃতি রোমন্থন ও ভবিষ্যত প্রকল্পের অনুমান― উভয়ের কোনওটিই নিষ্কলুষ, অবিমিশ্র, অক্ষুণ্ণ ও নির্ভুল নয়। আর এই কলুষ, মিশ্র, ক্ষুণ্ন ও ভুল কাজগুলো আমরা সম্পাদন করি আমাদের বর্তমানেই। কাজেই আমাদের বর্তমান কখনই ভ্রান্তিবিহীন নয়; হতে পারে না। চেষ্টা― কেবল সেই ভ্রান্তির পরিমাণ কতটুকু কমিয়ে আনা যায় সেটুকুই। সে জন্য প্রয়োজন অতীত-স্মৃতিকে যতটা অবিমিশ্র ও নিষ্কলুষভাবে স্মরণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্পকে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে আঁক কষে অনুমান করা।

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ― এই নিয়ে দীর্ঘ ভূমিকা উপস্থাপন করার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। রন্ধনশিল্পের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, রান্নার কাটাবাছা ইত্যাদি যোগাড়যন্ত্র করতেই বিস্তর সময় প্রয়োজন হয়। উনুনে বসানোর পর সময় লাগে অল্প। এই যোগাড়যন্ত্র বা প্রস্তুতি পর্বকে আমরা ভূমিকা বলতে পারি। ভূমিকা যতো মজবুত হয়, রান্না ততই স্বাদু হয়। মানবের আদি পিতা হযরত আদমকে আ. সৃষ্টির পূর্বেও মহান রাব্বুল আলামীন ফেরেশতাদের সামনে ভূমিকা উত্থাপন করেছিলেন। যদিও আল্লাহর জন্য এই ভূমিকার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এটাই আল্লাহপাকের সিফত। আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি আদেশ দিয়েছেন তাঁর রঙে রঙিন হতে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন খালদুন বিশ্বের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তার ভূমিকাস্বরূপ `আল-মুকাদ্দিমা` নামক মহাগ্রন্থ রচনা করে ফেলেছেন। কাজেই জীবনের কোনো একটা বিশেষ অধ্যায় নিয়ে অতীত-স্মৃতি রোমন্থন করার পূর্বে দীর্ঘ ভূমিকা উত্থাপন করার পার্থিব এবং আসমানি গুরুত্ব অবশ্যই আছে।

অবশ্য গুরুত্ব ব্যাপারটিও সময়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ সমাজ ও রাষ্ট্রে যা গুরুত্বপূর্ণ, আগামীতে তা হতে পারে একেবারেই অপাঙ্ক্তেয়। পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফে এমন কিছু যুবকের উল্লেখ ছিলো যাদের অস্তিত্ব ছিলো রোমান শাসনামলে। তারা ছিলো তাওহীদে বিশ্বাসী। রোমান শাসকবর্গ ও বেশিরভাগ জনগণ ছিলো রোমান দেবতাদের পূজারী। খ্রিস্টধর্ম তখন নবীন ধর্ম। খ্রিস্টধর্মের অনুসারীগণ রোমান শাসকদের রক্তচক্ষুর আড়ালে স্রষ্টার ইবাদত করতে থাকে। ইহুদী অনুচরেরা সেসব খবর রোমান শাসকদের কাছে নিয়মিত পৌঁছে দিতো। আর তাওহীদে বিশ্বাসী সেই খ্রিস্টানদের উপর জুপিটারের উপাসকরা চালাতো অকথ্য নির্যাতন। কাউকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো, কাউকে শূলে চড়ানো হতো। শাসকদের কঠিন নির্যাতনে ভীত হয়ে একদল সত্যনিষ্ঠ যুবক মহান রবের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। মহান প্রতিপালক তাদের প্রার্থনা কবুল করলেন। একটি পাহাড়ি গুহায় সেই যুবকদের তিনশো বছর এবং আরও নয় বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন― মৃত্যুসদৃশ দীর্ঘ ঘুম! যখন যুবকদের ঘুম ভাঙলো তখন যুবকেরা জানতে পারলো কিছুই আর পূর্বের মতো নেই। সেই অত্যাচারী শাসকেরা বিগত হয়েছে, রোমান দেবতার পূজারীদের পরাক্রম পরাভূত হয়েছে। নগরীর লোকেরা প্রকাশ্যে খ্রিস্টধর্ম পালন করছে। গীর্জার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পূর্বেকার সমস্ত রীতি-রেওয়াজ গুরুত্ব হারিয়েছে৷ এসব গূঢ় কথার ইশারা সমস্তই পবিত্র কিতাবাদিতে বর্ণিত আছে।

কিতাবের কথা থেকে জীবনের কথায় আসা যাক। সেখানেও এর কোন ব্যত্যয় ঘটে না। আমরা আমাদের শৈশবে যেসব রীতি এবং রেওয়াজ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে পালিত হতে দেখেছি, জীবনের মধ্যাহ্নে এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই সেই সব রীতি-রেওয়াজকে গুরুত্বহীন হয়ে যেতে দেখেছি! তিনশত বছর দূরে থাক, এই চার দশকেই যেসব পরিবর্তন দেখতে পাই তা লক্ষ্য করলে মনে হয় যেন আসহাবে কাহাফের মতো আমিও বোধহয় একটা লম্বা ঘুম থেকে জেগে উঠেছি! যেমন রমজান মাসের কথাই ধরা যাক না। আমাদের ছেলেবেলায় রোজা শুরু হতো শীতকালে। এখন তো ঋতুচক্রের পালায় গরমকালের দীর্ঘ দিনজুড়ে রোজা রাখতে হয়। তখন এমনটা ছিলো না। দিন ছিলো ছোট, রাত্রি ছিলো দীর্ঘ। কাজেই ছোট বয়সেও রোজা রাখতে তেমন সমস্যা হতো না। কেবল একটাই অসুবিধা ছিল, তা হলো সেহেরির সময় প্রচণ্ড শীতে লেপের নিচ থেকে বের হয়ে খাওয়াদাওয়া করতে বসা। দুনিয়ার আলসেমি পেয়ে বসতো সে সময়। হ্যাঁ, তখন আমাদের এখনকার মতো সেহেরি ও সাহরি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আমরা সেহেরি শেষে আবশ্যিকভাবে নিয়্যত করতাম, নাওয়াইতুয়ান আসুম্মা গাদাম্মিন শাহরে রমজানাল মুবারাকে ফার্দাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামীউল আলীম।

এখনকার মতো নিয়্যত করা বা না করা নিয়েও আমরা বিভ্রান্তিতে ভুগতাম না। আমরা ছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইফতারি বলতে আমরা ছোলা দিয়ে মাখানো মুড়িকেই বুঝতাম। সাথে থাকতো ঘরে বানানো পিঁয়াজু আর বেসনে ডুবানো বেগুনি। চটচটে আঠালো এক ধরণের সস্তার খেজুর আমাদের কাছে লোভনীয় ছিলো। ইফতারীতে পোলাও-বিরিয়ানি, ছোলা-খিচুড়ি, হরেক রকমের কাবাব, হালিম ইত্যাদি রকমারি পদ আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না তখন। আদতে ছোলামুড়ি ছাড়াও যে ইফতার হতে পারে তা আমি অনেক বড় হয়ে জেনেছি। চাকুরিজীবনের শুরুতে পোস্টিং ছিলো মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। সেখানে স্থানীয় এক সম্ভ্রান্তের বাড়িতে ইফতারের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে যেতে হয়েছিলো। ইফতারির প্লেট ছিল ছোলা, বেগুনি, পিঁয়াজু, নানান ফলমূলে সুসজ্জিত। এদিকে মাগরিবের আজান হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, অথচ মুড়ি দিচ্ছে না! আমি ভিতরে ভিতরে উশখুশ করছি। মুড়ি ছাড়া ইফতার করবো কিভাবে! শুধু ছোলা খাবো? অপেক্ষার অবসান ঘটলো, আজানের পর দেখলাম খিচুড়ি, মাংস ইত্যাদিতে এলাহী আয়োজন। সেই প্রথম ছোলামুড়ি ছাড়া ইফতারির অভিজ্ঞতা। এখন তো সময় কতো বদলে গেছে। নিজের ঘরেই একেক দিন কতো নিত্য পদের ইফতারির আয়োজন হয়। তবুও শৈশব-কৈশোরের সেই ছোলামুড়িমাখা ইফতারের আবেদন ছুঁতে পারে কি? রীতি-রেওয়াজ বদলে গেছে।

আমাদের সময় শবে বরাত ছিলো অন্য রকম আনন্দের রাত। শবে বরাত মানেই ছিলো দলবেঁধে রাতভর এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে যাওয়া, একশ রাকাত নামাজ পড়ার প্রতিযোগিতা, তারাবাতি নামক আতশ পোড়ানো, পটকা নামক বাজি ফাটানো, গোরস্থানের জাকজমক আলোক সজ্জা। আমাদের সময় শবে বরাত ছিলো ভাগ্য রজনী। এখনকার মতো তখনও তা খাঁট আরবীয় কায়দায় বারা`আত বা মুক্তির রজনী হয়ে ওঠেনি। লাইলাতু মিন নিফসি শব্দটা তখনও পরিচিতি পায়নি আমাদের কাছে। তখনও আমাদের কাছে শবে বরাত মানেই ছিল আর দিন পনেরো পরে রোজা, আর রোজা শেষ হলেই ঈদ! তারাবীর নামাজ নিয়ে আট রাকাত আর বিশ রাকাতের বিতর্ক আমাদের শৈশবে শুনিনি। ছেলেপেলের দল তারাবীর কথা বলে রাতে বের হতো। ছয় রাকাত কি আট রাকাত পড়ে কাতারের পিছন থেকে আস্তে করে কেটে পড়তো। তারপর দল বেঁধে মহল্লায় ঘুরাঘুরি কিংবা গোরস্তানে বসে আড্ডাবাজি। আর বিশ রাকাত শেষ হবার আগে আগেই আবার ভালো মানুষটির মতো গিয়ে পিছনের কাতারে দাঁড়ানো। এখনকার মতো প্রতি রমজানের আগে তারাবীর রাকাত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হতো না। এখন তো রমজান নাকি রামাদ্বান তা নিয়েও বিস্তর কেওয়াজ বাঁধে।

যে কথা বলছিলাম। রীতি-রেওয়াজ। বদলে যায়, বদলে যাচ্ছে। আগে মহল্লায় মহল্লায় কাফেলা বের হতো। সেহেরির সময় হলে কাফেলার ছেলেরা সুর করে করে ডাকতো, উঠুন, সেহেরি খা আ আ আন, সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছেএএএ…। নানারকম জারি গাইতো। চাঁনরাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলতো, যে যেমন পারতাম, দিতাম। কাফেলার মুরুব্বি লোকটার চেহারা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। কাদির মুন্সি না কি যেন নাম ছিল তার। চৌকো চোয়াল, গালের মাংস ছিলো ভিতরের দিকে ঢোকানো, দাঁত অধিকাংশ ছিল না বলেই এই অবস্থা। থুতনিতে অল্প দাড়ি। আশ্চর্য! তাকে আমি সব সময় এরকমই দেখেছি! এমনকী তার পায়ের খড়ি উঠে যাওয়া চামড়ার ডোরাকাটা দাগগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে। লোকটা লুঙ্গি কিছুটা উঁচুতে পরতো বলে পায়ের অনেকটা অংশই দেখা যেতো। তার মৃত্যুতে কতটুকু বেদনাহত হয়েছিলাম তাও যেন আজ মনে করতে পারছি। সেই লোকগুলো মরে গেছে। সেই রীতিগুলোও। সময়ের সাথে সাথে।

আমাদের সে সময়গুলো ভালো ছিলো কি খারাপ ছিলো তা বড় কথা নয়। সেই রীতি এবং রেওয়াজগুলো ভুল ছিল কি সহীহ ছিলো সে বিতর্কেও যাবো না। আজ এই মহামারী আক্রান্ত করুণ সময় তো আরও অনেক কিছুই বদলে দিলো! তারাবী বিশ কি আট দূরে থাক, মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করার ভাগ্যই তো এখন বেশিরভাগ মানুষের হচ্ছে না। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারা`আত নিয়ে বাহাস দূরে থাক, হালুয়া-রুটির রসম ভালো কি মন্দ ছিলো সেই বিতর্কও দূরে থাক, এই সময়ে যে সামাজিক দূরত্ব নামের এক অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হচ্ছে, এটাও তো সময়েরই প্রভাব। এই মৃত্যুময়, এই বিচ্ছেদপীড়িত, এই ক্ষুধার্ত সময়কে আমি মন্দ বলি না। কেননা এই সময় আমাদের এমন বিরল কিছু অভিজ্ঞতা প্রদান করছে যা আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও পেতাম না। আমি সময়কে মন্দ বলি না; কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, `তোমরা সময়কে গালি দিও না, কারণ সময়ের নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন আল্লাহ`। আমরা সেই মহান রবের কাছেই আশ্র‍য় প্রার্থনা করি, যেন তিনি সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই এ সময়কে পরিবর্তন করে দিয়ে আমাদের আরও একটি সুসময়ে জাগিয়ে তোলেন আসহাবে কাহাফের মতো। সেই আশায় আমি গুণগুণ করে আবৃত্তি করি―

সূরা কাহাফের রাত্রি হয়েছে শুরু
নীরবতা ভাঙ্গে গম্ভীর তিলাওয়াতে
মাখরাজে আজ ওঠানামা করে ঢেউ
যে বাণী বয়েছে হাজার ফারিশতারা
সূরা কাহাফের রাত্রি হয়েছে শুরু…