সুরঞ্জনার গদ্য ‘ঊর্মিরা ফেরে না আর’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৫, ২০২১

যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আবার জ্ঞান হারালো ঊর্মি। অনেকক্ষণ সে ভাবার চেষ্টা করছিল, কোথায় ও? কোন জায়গা? কারা লোকগুলো? দমবন্ধ করা পরিবেশ, আবছা কালো কিছু মূর্তি আর কিছু শব্দ কানে আসছিল ঊর্মির।

ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৩টে হবে। শীতকাল, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন শহর। ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলো শুনতে পেল গাড়ির ক্যাচ শব্দ। কেউ আবার শুনতেও পেল না। পরেরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল শহরের, দেখলো বস্তাবন্দি একটা লাশ।

লোকজন ভিড় জমালো ধীরে ধীরে। পথচলতি কিছু মানুষ আসে। দ্যাখে, ছবি তোলে। আবার কেউ আলোচনা করে ফিসফিসিয়ে। বেলা বাড়তে পুলিশের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গেল লাশটাকে। কয়েকটি খবরের কাগজের লোকজনকেও দেখা গেল ঘোরাঘুরি করতে।

মুখ থেঁতলানো একটা লাশ। কোনো পরিচয়পত্র কিছুই পাওয়া গেল না লাশের থেকে। পাওয়া যাবেই বা কি করে? বিবস্ত্র, মুখ থেঁতলানো একটা লাশ তো। শুধু শরীরের গঠন আর ক্ষতবিক্ষত যোনি দেখে বোঝা যায়, এটা একটা মেয়ে লাশ।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উঠে এলো বারবার ধর্ষণ ও কিছু ভারি জিনিস দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার কথা। পুলিশ খোঁজ চালালেও কোনো কিনারা করে উঠতে পারলো না এই রহস্যের ও এই বেওয়ারিশ লাশের।

মফস্বল থেকে প্রত্যেকদিন ট্রেনে করে শহরে কাজে আসে বহু মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের একমাত্র সম্বল। তাদের উপার্জনেই হয়তো সংসার চলে। কাজে শহরে আসা মানুষ, না না, মানুষ নয়, মেয়েমানুষরা অনেকের রোজকারের উপায় বলে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে দেহ ব্যবসাকে।

এত কথা বলা শুধু ঊর্মির পরিচয় দেয়ার জন্য। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন ঊর্মি এরকমই একটি মেয়ে। ঊর্মি মণ্ডল,বয়স ১৯। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ। আর নিবাস সেটা কাউকে বলতে চাইতো না সে। শুধু বলতো, অনেক দূর, চিনবে না তোমরা।

আর বেশি কিছু বলতে পারবো না। ও নিজের সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলত না। একবার বলেছিল, আমি পড়াশুনা জানি। মাধ্যমিক পাশ করেছি।

সকালের আসে, শরীর বেচে। কত পুরুষ শুয়ে পড়ে ওর শরীরের উপর। ও চুপ থাকে শুধু টাকাটা নেবার সময় গুনেগুনে নেয়। এটাই ঊর্মির নিত্যদিনের নিয়ম। কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল। সেইদিন বেরিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ এক কাস্টমার এসে হুরজুতি শুরু করলো তার সাথে।

তাকে যেতেই হবে, শুতেই হবে। জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেল তাকে। ধর্ষণ করলো। পুলিশের কাছে গেলে তারা ডায়েরি নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিলো। উল্টে শুনতে হলো, বেশ্যা মাগী, নষ্ট মেয়েছেলে! তোদের আবার কে চুদবে রে? যা ভাগ এখান থেকে।

অপমানে, অসম্মানে যেন মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছা করলো ঊর্মির। ফিরে এলো। ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনের দিকে এগোতে লাগলো। হঠাৎই একটা গাড়ি এসে টেনে তুলে নিলো তাকে। তারপর কতবার কতজনের বিকৃত কামের শিকার সে, তা সে নিজেও জানে না, হিসেব রাখতে পারেনি। যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় ঊর্মি।

এখন যৌনপল্লী কেউ জানে না ঊর্মির ঠিকানা। শুধু জানে ঊর্মি আর আসে না। এইভাবে হারিয়ে যায় ঊর্মি যায়! শুধু যৌনপল্লীর অন্ধকার গলি নয়, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি থেকেও হারিয়ে যায় কত ঊর্মি! তারা আর ফেরে না!

লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী