সৃষ্টির সেরা জীব পর্যদুস্ত এক অনুজীবের কাছে

নিলয় সরকার

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২০

আমরা অনেকেই এখন মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা অনুভব করছি, আবার অনেকে হয়তো করছিও না। এর কারণ, বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোনো কিছুতেই এ জাতির কিছু এসে যায় না। ফলে দিনকে দিন করোনায় মৃতের সংখ্যা বাড়লেও আমাদের খুব একটা আতঙ্ক নেই এ নিয়ে। বরং করোনা যে মানুষ মরবে, এটা এখন সবারই গা-সওয়া হয়ে গেছে।

ভয়াবহ এই অবস্থা এখন বিশ্বজুড়ে। আজ মানুষ তার জীবন নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত, আরও বেশি ভীত নিজের মা-বাবা এবং বয়স্ক প্রিয়জনদের জন্য। যেহেতু তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। কেউ করোনায় মারা গেলে মৃত ব্যক্তির সব আত্মীয়-স্বজনরা একসাথে মিলিত হয়ে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ঠিকমতো মৃতদেহের সৎকার পর্যন্ত করতে পারছে না অনেকেই। সৃষ্টির সেরা জীব আজ এরকম পর্যদুস্ত এক অনুজীবের কাছে।

এই করোনা হয়তো একদিন চলে যাবে, কিন্তু আমরা কি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করবো? করোনা অনেক প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, অর্থনীতির অনেক ক্ষতি সাধন করছে। কিন্তু সাথে কিছু ভালো প্রয়োজনীয় শিক্ষাও দিচ্ছে। এই যেমন, যেখানে সেখানে কফ-থুতু না ফেলা, হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা, হাত ধোয়া, পরিষ্কার থাকা, বন্য জীবজন্তুর মাংস না খাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি ভবিষ্যতেও এগুলো মেনে চলবো নাকি আমার মতো পরীক্ষার সময় টের পাব যে, আগে থেকে একটু পড়া উচিত ছিল। শপথ করবো, পরের সেমিস্টারে আর এমন ভুল করবো না। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলেই সব ভুলে গিয়ে আবার আগের মতোই চলতে শুরু করবো।

এখানে একটা পার্থক্য হলো, পরীক্ষায় খারাপ করার ফল শুধু ব্যাক্তিগতভাবে নিজেকেই বহন করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু মানুষের ভুলের ফলাফল পুরো পৃথিবীকে ভোগ করতে হবে। আরেকটি বড় শিক্ষা যেটা আমাদের গ্রহণ করা উচিত তাহলো, প্রকৃতির উপর সবধরনের জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। তা না-হলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের Global warming ফলে ভবিষ্যতে পৃথিবীতে যে মহাদুর্যোগ আসবে, করোনা তার কাছে হয়তো কিছুই নয়। ভবিষ্যতে করোনার থেকে আরও বড় বড় মহামারিতে আমরা পড়বো যার মোকাবেলা করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

এক ভাইরাসই আমাদের সীমাবদ্ধতা আর অসহায়ত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বাইরে বের না হয়ে ঘরে থাকা আর বের হলে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ছাড়া প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই আপাতত।  পৃথিবীকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এর আগে গুরুত্বপূর্ণ আইন করে পারমাণবিক ও জৈবিক অস্ত্রের Biological weapon ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আরেকটি বৈশ্বিক আইন করে প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন সব কাজ নিষিদ্ধ করা উচিত; কোনো দেশের সরকার বা ব্যাক্তি এমন কাজ করতে পারবে না যার প্রভাব সমগ্র বিশ্বে পড়বে। বিশ্বব্যাপী বনভূমি ধ্বংস করা, পরিবেশ দূষণ করা, বন্যপ্রাণী নিধন করা নিষিদ্ধ করা উচিত, আর আইন করে নিষিদ্ধ করা উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে চলা সব যানবাহন, ফ্যাক্টরি, কলকারখানা।

পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা সম্ভব না হলে একদম সীমিতকরণ করে সামান্য কিছু অতিপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্র বাদে বাকি সব বন্ধ করা উচিত এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প খোঁজা উচিত। এই আধুনিক সভ্যতা আর শিল্প উন্নতি কতটা যৌক্তিক যেটা পৃথিবীকে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাৎক্ষনিক দৃশ্যমান উন্নতির ঝলকে দূরবর্তী লুকায়িত ধ্বংস আমরা দেখতে পাচ্ছি না বা দেখেও গুরুত্ব দিচ্ছি না, কিছু করছি না। আমরা কেন করছি না? আমরা কি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার জন্য অপেক্ষা করছি! হয়তো ভাবছি এখনও অবস্থা সেরকম হয়নি, পরে হলে করা যাবে। কিন্তু যখন আমরা মহামারিতে পড়বো তখন আর করার কিছুই থাকবে না। একটা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলেই হয়তো করোনাকে দূর করা যাবে কিন্তু পূর্ব থেকে সচেতন না হলে আর ব্যবস্থা না নিলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে যে মহাদুর্যোগ আসবে সেটা কি ঠেকানো যাবে? তখন সবকিছু বন্ধ করে, সব লকডাউন করেও বাঁচা যাবে না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাল নয়, আজ এখন থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিক লাভের কথা চিন্তা না করে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। অন্তত নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে আমাদের সব রাজনীতি, ব্যাবসায়িক সংকীর্ণতা, বিভক্তি আর ভেদাভেদ বন্ধ করে এক হওয়া উচিত। কারণ মহামারি কোনো ভেদাভেদ করে না, মৃত্যু কোনো ভেদাভেদ করে না।

এই দেখুন না, সাম্যবাদী করোনা দেখছে না কে প্রিন্স চার্লস আর কে ফকির, কে উঁচু আর কে নিচু। এখন আর কেউ বলছে না, প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের ঘোষনা দিয়েছে আমরা বিরোধীদল সেটা সমর্থন করবো না। কারণ এটা জীবনের প্রশ্ন। করোনা দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। সবাই আজ করোনার বিপক্ষে একদলে। সেই একদল আমরা আগেই কেন হই না? কেন সবাই এক হয়ে পৃথিবীর পক্ষে আর প্রলয়ের বিপক্ষে দাঁড়াই না?