স্তালিনকে ‘উপড়ে ফেলা’ যায়নি, জিন্দাবাদ তারই প্রাপ্য

ওমর তারেক চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০১৯

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যাহীন বিবরণ, একপেশে অসম্পূর্ণ তথ্য, মনগড়া সংবাদ ও অজ্ঞতা, অযৌক্তিক আবেগের সুড়সুড়ি দেয়া নাম ভাঙানোর (পাঠককে মোহিত করতে অকারণে এরেনবুর্গ ও গ্রামসির নামোল্লেখ) বৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে বাহ্যিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে লেখা প্রথম আলো পত্রিকার ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি’ হাসান ফেরদৌসের ‘স্তালিনবাদকে যাঁরা জিন্দবাদ দিচ্ছেন’ উপ-সম্পাদকীয়টির (প্রথম আলো। ২১ জুলাই ২০১৯) বিভ্রান্তির অবসান জরুরি। বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে বিস্তারিতভাবে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন জরুরি হলেও স্বল্প পরিসরে (প্রথম আলোসহ ঢাকার দৈনিকগুলো ৮০০ শব্দে লেখা শেষ করার যে ফর্মুলা অনুসরণ করে তার কথা বলা হয়েছে) তা করা অসম্ভব বিধায় এখানে মূলত হাসান লিখিত স্তালিন সম্পর্কে মনগড়া ও অজ্ঞতাপ্রসূত ভিত্তিহীন মন্তব্য, মহাপরাক্রমশালী সেই কমিউনিস্ট নেতার প্রায় সব মূর্তি উপড়ে ফেলা হয়েছে, বিষয়েই এই ভিন্নমতে বিপরীত সত্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

যে আত্মপ্রসাদ ও বিদ্বেষসহ হাসান ফেরদৌস স্তালিনকে ‘উপড়ে ফেলা’র সংবাদ দিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করেছেন. তা পুরো সত্য নয়। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার নির্মাতা স্তালিনকে মুছে ফেলার সুসমাচারটি সঠিক হলে তাঁর লেখার উপযুক্ত পাঠকরা হয়ত খুশি হতেন। কিন্তু, পশ্চিমা দুনিয়ার হাত ধরে বিরামহীনভাবে চলা স্তালিন-বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্যেও বিগত দুই দশক ধরে রাশিয়ার মানুষের মনে স্তালিন বিষয়ে প্রশংসা, ভালোবাসা ও মর্যাদা সংক্রান্ত  উল্লেখযোগ্য সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘোরানো সোভিয়েট নগরী স্ট্যালিনগ্রাদের (১৯২৫-৬১ সাল পর্যন্ত বহাল নাম) নাম পাল্টে ভলগোগ্রাদ করা হয়েছিল খ্রুশ্চভদের নিস্তালিনীকরণের অংশ হিসাবে। টাইম ম্যাগাজিন (Stalingrad: On the 70th Anniversary of a Tide-Turning Battle, a Controversial Name Makes a Comeback. By Yue Wang. ২.৩.১৩) ও গার্ডিয়ান (Stalingrad name may return to city in wave of second world war patriotism. By Alec Luhn৮.৬.১৪) প্রতিবেদনে জানিয়েছে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ার্জনের ৭০তম বর্ষপূর্তির সময় রাশিয়ার নাগরিকরা, বিশেষত প্রবীণ সৈনিকরা, নগরীটির নাম স্তালিনের নামে ফিরিয়ে আনার দাবী জানান। তাঁদের কথা ছিল: আমরা স্তালিনের নামে লড়েছি, শহরটিকে নাৎসীদের হাতে তুলে না দিতে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, নাৎসীদের পরাজিত করেছি; তাই স্তালিনগ্রাদই হোক শহরের নাম। সে সময় বিজয় উদযাপনের জন্য নগরটির নাম সাময়িকভাবে স্তালিনগ্রাদ হিসাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, নগরে চালু হয়েছিল স্তালিনের ছবিযুক্ত বাস সার্ভিস (‘Stalin buses’ to mark 70th anniversary of Battle of Stalingrad in Russia. ৩১.১.১৩)। স্তালিনের ছবি সম্বলিত অনুরূপ বাস সার্ভিস, বিজয়ের বাস, চালু হয়েছিল লাতভিয়া ও এস্তোনিয়ার রাজধানীতে (Buses with Stalin`s image to appear in Latvia and Estonia on May 9.)। ইন্টারনেটে চালু হওয়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্তালিন বাসের এই প্রচারণা তৃতীয় বর্ষে প্রাক্তন সোভিয়েটে ইউনিয়নের ৪০টি শহরে চালু হবার সচিত্র সংবাদ আছে (https://www.rt.com/russia/stalin-bus-victory-russia-645/)।

অবশেষে ঠিক হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনের নেতৃত্ব ও অবদানকে স্মরণ করতে বছরে নয়টি দিন ভোলগোগ্রাদ পরিচিত হবে স্তালিনগ্রাদ হিসাবে। নিউইয়র্ক টাইমস (A Monster to History, Stalin Is a Tourist Magnet in His Hometown. ৩০.৬.১৯) ও ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট (Stalin Museum: The creepy attraction in Georgia that still worships the communist leader like a god. ২১. ১১.২০১৭) স্তালিনবিষয়ে সংবাদ দিয়েছে। এ মনস্টার টু হিস্টোরি, স্ট্যালিন ইজ এ টুরিস্ট ম্যাগনেট ইন হিজ হোমটাউন শিরোনামে টাইমস জানাচ্ছে: স্তালিনের জন্মস্থল জর্জিয়ার গোরিতে ১৯৫৮ সালে স্থাপিত ‘স্তালিন জাদুঘর’টি নিস্তালিনীকরণের আক্রোশ এবং এটিকে বন্ধ করার সাম্প্রতিক চেষ্টা উপেক্ষা করে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর ভাষ্য) মহাসমারোহে স্তালিনের অমর কীর্তির ইতিহাস তুলে ধরছে। গত বছরই ১,৬২,০০০ দর্শনার্থী (অধিকাংশ রুশ ও চীনা) এসেছেন এই জাদুঘরে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছে: ‘লক্ষণীয়ভাবে জাদুঘরটির মূল ফ্লোরে একনায়কের খুনখারাবির অতীত ও নীতি সম্পর্কিত কিছুর উল্লেখ নেই।’ স্তালিনের জন্য ভালোবাসা আর মর্যাদার সাক্ষী হয়ে উঠেছে জাদুঘরের গাইডদের বিবরণ ও প্রদর্শিত সামগ্রীগুলো।

রাশিয়ার পেশাদার জরিপকারী প্রতিষ্ঠান লেভাডা সেন্টারের ২০০১ সাল থেকে পরিচালিত ধারাবাহিক জরিপের ফল স্তালিনকে ‘উপড়ে ফেলা’ নিয়ে অজ্ঞতা দূর করবে। ২০১৭ (নিউজউইক। Stalin More Popular Than Putin, Russians Say. ২৬.৬.) ও ২০১৯ (দ্য টেলিগ্রাফ। Record 70 per cent of Russians say Stalin played a positive role in their country`s history. ১৬.৪.) সালের জরিপের ফল: ’১৭ সালে ৩৮% রুশ স্তালিনকে তাদের দেশের অসাধারণ দশজন মানুষের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন (’১২ সালে স্তালিনের পক্ষে ছিল ৪২% ভোট) এবং সর্বশেষে ’১৯ সালের জরিপে দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখায় স্তালিনের জনপ্রিয়তার হার উন্নীত হয়েছে ৭০%য়ে। গত ১৯ বছরে স্তালিনের প্রতি রাশিয়ার মানুষের মনোভাব নেতিবাচকতা ও নিন্দাবাদ কাটিয়ে ক্রমশ প্রশংসা ও মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে বলে লেভাডার বিশ্লেষক কারিনা পিপিয়া জানিয়েছেন (ব্লুমবার্গ। Russian Support for Stalin Surges to Record High, Poll Says. ১৬.৪. ১৯)।

টেলিগ্রাফয়ের বিবরণ আরও জানিয়েছে: সাইবেরিয়ার শহর নভোসিবির্ক্সয়ে স্তালিনের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং সেখানকার একটি গ্রামের প্রধান ইতিমধ্যে গ্রামের ২৫টি রাস্তাকেই সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে সবগুলোর নামকরণ করেছেন স্তালিনের নামে!

আজকের রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়ায় স্তালিনের অবস্থানের প্রতিফলন পাওয়া যাবে মার্কিন রক্ষণশীল গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগী এনডাওয়মেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত গবেষণায় (Carnegie: Stalin still admired in ex-Soviet lands. By Vladimir Isachenkov. ১.৩.১৩)। গবেষণাটির অন্যতম ফলাফল হিসাবে জানা যাচ্ছে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর স্তালিনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে (স্মর্তব্য যে ১৯৫৬ সাল থেকে খ্রুশ্চভরা সোভিয়েট ইউনিয়নে নিস্তালিনীকরণ যজ্ঞ শুরু করেছিল, যার হাত ধরে পশ্চিমা বিশ্বে বিরামহীনভাবে স্তালিনবিরোধী প্রচারণা অধিকতর শক্তিশালী নিয়মিত হয়ে ওঠে)। জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে (এখানে স্তালিনকে অনেক বেশি নেতিবাচক হিসাবে দেখা হয়) তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে যথাক্রমে ৪৫, ৩৮ ও ২২ শতাংশ করে।

উল্লেখিত প্রতিনিধিত্বমূলক সংবাদেই ‘উপড়ে ফেলা’র ভিত্তিহীন কাহিনীর শেষ না। সোভিয়েট সরকার ও পার্টির মহাফেজখানা উন্মুক্ত হলে অনেক গবেষকের মতোই ইয়েল ইউনিভারসিটি প্রেসের অ্যানালস অফ কমিউনিজম সিরিজয়ের গবেষক জোনাথন ব্রেন্ট ১৯৯২ সালে স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত মহাফেজখানা নিয়ে গবেষণার (ইনসাইড দ্য স্ট্যালিন’স আর্কাইভস: ডিসকাভারিং দ্য নিউ রাশিয়া) জন্য রাশিয়া গিয়েছিলেন। স্তালিন, রাশিয়া, সেখানকার মানুষের আচরণ ও মানসিকতা নিয়ে তাঁর বিস্ময় ও বিচলিত হবার কিছু বিবরণ আছে ২০০৯ সালে লেখা বইটির মুখবন্ধে (নিউইয়র্ক টাইমস। ‘Inside the Stalin Archives’. By Jonathan Brent. ২৩.১.০৯)।  তিনি দেখেছেন মস্কোর শেরেমিটিয়ভ বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপে স্তালিনের ছবিসম্বলিত প্যাকেটে চকলেট বিক্রি হচ্ছে। জোনাথন লিখেছেন: ‘সরকারি দালানগুলো থেকে দীর্ঘকাল আগে অপসারিত হলেও, স্তালিনের নাম ও তাঁর বাণী সাধারণ মানুষের ঠোঁটে রয়ে গিয়েছে এবং প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে এখনও দেখা যায় তাঁর আবক্ষ বা পূর্ণ মূর্তি।’

বিরোধীদের কুৎসা এবং হাসান ফেরদেৌসের মতো ব্যক্তির অন্ধ বিদ্বেষের উপর ইতিহাস, জনগণের স্মৃতি ও বিচারবুদ্ধি যে নির্ভর করে না; প্রদত্ত সংবাদগুলো তারই প্রমাণ। স্তালিনের নেতৃত্বে ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চাদপদ দেশ রাশিয়া রূপান্তরিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশে; যে দেশকে পিষে মারতে যুগপৎভাবে তিন বছরব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল আমেরিকাসহ চোদ্দটি দেশ, ভেতরে ছিল নানা ধরনের শত্রুদের সাথে সুদীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধ ও লাগাতার অন্তর্ঘাত, প্রতিষ্ঠার ষোল বছর পর মার্কিন স্বীকৃতি প্রাপ্তি সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি বৈরিতার তীব্রতাকেই নির্দেশ করে। জোটবদ্ধ বৈরিতা সমাজতান্ত্রিক দেশটিকে জার আমলের চেয়ে বেহাল অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল। অনেক পিছিয়ে থাকা রাশিয়াকে দুই দশকেরও কম সময়ে স্তালিন উন্নীত করেছিলেন শিল্পোন্নত দেশে। দেশকে দিয়েছিলেন উন্নত কৃষিব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আবাস-সমতা-নারী ও বিভিন্ন জাতিসত্তার উন্নতি ও মর্যাদা। সামরিক প্রস্তুতি, বিচক্ষণতা আর শক্তিতে সমগ্র সোভিয়েটবাসীকে সমবেত করে, সর্বোচ্চ জীবনদানের বিনিময়ে হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দানবকে হটিয়ে পৃথিবীকে নিরাপদ করেছিলেন। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ কোনো ভুলত্রুটি-বিচ্যুতি-’বাড়াবাড়ি’ (সাম্রাজ্যবাদীদের বিরামহীন অভিযোগ) ছাড়া সম্পন্ন করা হয়তো কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কিন্তু, অবিচল আদর্শনিষ্ঠা ও দায়িত্বজ্ঞান বোধ; এবং পরিবেশ, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি তো মানুষ ছিলেন— এসবই যুক্তিসঙ্গত বিবেচনায় নেবার কথা তাঁর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। ত্রুটিবিচ্যুতিসহ রাশিয়া ও বিশ্বের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক অবদানের কথাই আজও সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নসহ বিশ্বের বহু মানুষের চেতনা ও স্মৃতিতে জাগরূক আছে। স্তালিনের মৃত্যুর পর রুশ সাহিত্যিক ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন খ্যাতিমান সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবুর্গ প্রাভদা’তে সঠিকভাবে লিখেছিলেন: স্তালিনের মৃত্যু নেই, তিনি মৃত্যুহীন! এ কারণেই স্তালিনকে উপড়ে ফেলা যায়নি আজও। জিন্দাবাদের নারা ন্যায়সঙ্গতভাবে জোসেফ স্তালিনেরই প্রাপ্য।

ইচ্ছাকৃতভাবে এই নিবন্ধে ব্যবহৃত সকল তথ্য নেয়া হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার মূলধারার বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম থেকে। লক্ষ রাখা প্রয়োজন, এসব পত্রিকা সংবাদ দিতে বাধ্য হলেও, সেসব বর্ণনার প্রতিটি ছত্রে উৎকট স্তালিন-বিদ্বেষ ও তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা কোনোভাবেই কোনো লুকানো বিষয় নয়।