কবীর

কবীর

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৭৬

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২২

সন্ত কবীর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেন। ধর্ম বিষয়ে তিনি যেসব কথা বলেন তা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গায়ে লাগে। একদিন উভয় সম্প্রদায় মিলে কবীরের বিরুদ্ধে নালিশ করল তৎকালীন দিল্লির সুলতান সিকান্দার শাহ লোদীর কাছে। কবীরকে ডেকে পাঠালেন সুলতান। কবীর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। বাদীপক্ষের কাঠগড়ায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজনকে দেখে তিনি অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘ভালোই হয়েছে। তবে ঠিকানায় একটু ভুল হয়েছে।’

সুলতান বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ভালো হয়েছে? কোন ঠিকানা ভুল হয়েছে?’ কবীর বললেন, ‘হিন্দু-মুসলমানকে মিলানোই আমার লক্ষ্য ছিল। সবাই বলত এটা অসম্ভব। আজ তা সম্ভব হলো। ঠিকানা ভুল হয়েছে মানে হচ্ছে, এরা একই ঈশ্বরের দরবারে মিললে ভালো হতো, মিলেছে সুলতানের দরবারে।’ সুলতানের উদ্দেশে কবীর বললেন, ‘তোমার মতো জগতের রাজার সিংহাসনতলে যদি এই মিলন সম্ভব হয়, তবে বিশ্বের অধিপতির সিংহাসনতলে কি আরও প্রশস্ত স্থান মিলবে না?’ সুলতান লজ্জিত হয়ে কবীরকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

কবীর ছিলেন সুলতান সিকান্দার শাহ লোদীর (১৪৮৯-১৫১৯) সমসাময়িক। উইলিয়াম উইলসন হান্টারের মতে ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন কবীর। ১৩০০-১৪২০ খ্রিষ্টাব্দকে তিনি কবীরের সময়কাল বলে উল্লেখ করেছেন। কবীরের জন্ম হিন্দুদের তীর্থস্থান কাশীতে, মুসলমান জোলা পরিবারে। যদিও তিনি হিন্দু না মুসলিম, এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। হিন্দুরা বলে তিনি হিন্দু, মুসলমানরা বলে মুসলমান। কবীর-পরবর্তী বঙ্গীয় সাধক লালন সাঁইকে যেভাবে ভাগাভাগি করতে দেখা যায় ঠিক তেমন।

বিশিষ্ট পণ্ডিত ও গবেষক ক্ষীতিমোহন সেন নানা গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে কবীরের জন্ম মুসলমান জোলা পরিবারে। ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ‘দবিস্তান’ গ্রন্থে লিখেছেন কবীর যে জোলা বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। হলেও কবীর সেই অর্থে মুসলমান ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুলত একেশ্বরবাদী এবং সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী।

মধ্যযুগে ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে যেসব গৌণ ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল, তার প্রতিটিতে কিছু না কিছু হলেও সন্ত কবীরের প্রভাব রয়েছে। কবীর ছিলেন সাধক রামানন্দের শিষ্য। জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা, তীর্থভ্রমণ, ব্রত, মালা, তিলক প্রভৃতির ধার ধারেননি তিনি। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমান ধর্মের সকল কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরোধী। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধক ও জ্ঞানীদের সঙ্গে তিনি আড্ডা দিয়ে বেড়াতেন। সূফিদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। হিন্দু-মুসলমান সাধকদের সঙ্গে সাক্ষাতের তৃষ্ণায় ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করেছেন। পুরীতে ছিলেন দীর্ঘকাল। মক্কা, বাগদাদ, সমরখন্দ, বোখারা প্রভৃতি স্থানের সাধকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তখন বাগদাদ ছিল উদার চিন্তার সাধকদের চিন্তাচর্চার প্রসিদ্ধ ক্ষেত্র।

কবীর ছিলেন সাধক। তাই বলে তিনি সংসারধর্মকে উপেক্ষা করেননি। বিয়ে করেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল লোই। তাঁর ছিল এক পুত্র, যাঁর নাম কমাল এবং এক কন্যা, যাঁর নাম কমালী। সাধক বলে কর্মকে তিনি গৌণ মনে করেননি। সাধন অর্থে তিনি শ্রমবিমুখতা বুঝতেন না। নিজে জোলার কাজ করতেন, কাপড় বুনে বাজারে বিক্রি করতেন। তাঁর দোঁহায় উল্লেখ :
কহৈঁ কবীর অস উদ্যম কীজৈ
আপ জীয়ে ঔরন কো দীজৈ।
অর্থাৎ, এমন শ্রম করবে যা ভিক্ষার ওপর নির্ভর না করে নিজের চলে এবং সম্ভব হলে অপরকেও সহায়তা করা যায়।

তাঁর পুত্র কমালও ছিলেন সাধক। পিতার মৃত্যুর পর কমালকে সবাই বলল, ‘তুমি তোমার বাবার শিষ্যদের নিয়ে সম্প্রদায় গড়ো তোলো’। উত্তরে কমাল বললেন, ‘আমার বাবা তো চিরজীবন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন আমি যদি সম্প্রদায় গড়ে তুলি, তবে তা হবে পিতার সত্যকে হত্যা করা। এটা একপ্রকার পিতৃহত্যা। এটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’

মধ্যযুগের সব সাধক ছিলেন গানপ্রিয়। কবিতা ও গানরে মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের বাণী প্রচার করতেন। কবীরও ছিলেন গীতিকার। নিজে গান রচনা করতেন, গাইতেন। বাণী প্রচার করতেন গানের মাধ্যমে। তাঁর বাণীর সারমর্ম হচ্ছে, ‘সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য সব কৃত্রিম বাধা পরিত্যাগ করে সত্য হও, সহজ হও। সত্যই সহজ। সেই সত্যকে বাইরে খুঁজে বেড়ানোর দরকার নেই। তীর্থে, ব্রতে, আচারে, তীলকে, মালায়, ভেখে, সাম্প্রদায়িকতায় সত্য নেই। সত্য আছে অন্তরে। তার পরিচয় মেলে প্রেমে, ভক্তিতে, দয়ায়। কারো প্রতি বৈরিভাব রেখো না, হিংসা করো না। কারণ, প্রত্যেক জীবের মধ্যে ভগবান বিরাজিত।’

সেই কালে তো সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য। কিন্তু সংস্কৃত তো পণ্ডিত-ব্রাহ্মণরা ছাড়া সাধারণ মানুষ বোঝে না। কবীর চান তাঁর কথা সবাই বুঝুক। তিনি সরল হৃদয়ের কথা সহজ ভাষায় ব্যক্ত করতে চান। তাই তিনি সংস্কৃত ছেড়ে চলিত হিন্দি ভাষাতেই গান রচনা করতেন। তাঁর দোঁহায় উল্লেখ, ‘সংস্কৃত কূপজল কবীরা ভাষা বহতা নীর।’ অর্থাৎ, হে কবীর সংস্কৃত হলো কূপজল, আর ভাষা হলো প্রবহমান জলধারা।’

হিন্দু-মুসলমান সমাজের অর্থহীন বাহ্য আচার ছিল কবীরের কাছে গুরুত্বহীন। তাঁর গুরু রামানন্দের মৃত্যৃর পর শ্রাদ্ধ করার জন্য শিষ্যরা কবীরের কাছে এলো দুধ চাইতে। কবীর একটি মরা গরুর পিঞ্জরের কাছে গিয়ে দুধ চাইলেন। শিষ্যরা তিরস্কার করতে লাগল। এ কেমন কথা! মরা গরু কি দুধ দিতে পারে? কবীর বললেন, ‘মরা মানুষের খাদ্য হিসেবে মরা গরুর দুধই ভালো।’

একদিন জাহানগন্ত নামে এক মুসলমান সাধক দেখা করতে এলেন কবীরের সঙ্গে। বাড়ির আঙ্গিনায় একটি শূকরকে চরতে দেখে ঘৃণায় তিনি চলে যাচ্ছিলেন। কবীর ডাক দিয়ে বললেন, ‘বাবা, এখনো তোমার এসব সংস্কার আছে? শূকর তো মলিনতা, কিন্তু অন্তরে কি মলিনতা নেই?’

কবীর বলেন, ধর্মের আলাদা আলাদা নাম হলেও সব ধর্মের অনুসারীরা একই ভগবানের সন্ধান করছে। কাজেই ঝগড়া বৃথা। হিন্দু-মুসলমান বৃথাই ঝগড়া করে মরল। অহংকার দূর করে, অভিমান ত্যাগ করে, কৃত্রিমতা ও মিথ্য পরিহার করে সকলকে আত্মার আত্মীয় মনে করে ভগবৎপ্রেমে, ভক্তিতে চিত্ত পরিপূর্ণ করো, তবেই সাধনা সফল হবে। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, তোমার অন্তরেই ভগবান আছেন। সেখানেই সহজে তাঁকে পাবে। শাস্ত্র, তীর্থ, আচার ও তর্কের পথে বৃথা ঘুরে মরবে। তোমার নিজের মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড। কাজেই বাইরে না ঘুরে অন্তরে বিশ^তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করো। বিশ^নাথ সেখানে বিরাজমান।

হিন্দু-মুসলমান বিভেদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা করেছেন কবীর। তাঁর দোঁহায় বলেছেন, ‘অসরে ইন্ দুহু রাহ ন পাঈ/হিন্দুকী হিন্দুওয়াই দেখী, তুর্কন কী তুর্কাঈ।’ অর্থাৎ, ওরে, এরা দুজনেই পথ পায়নি। হিন্দুর হিন্দুত্ব দেখেছি, আর মুসলমানের মুসলমানত্ব।’ কবীর আরো বলেন, ‘হিন্দু কহত হৈ রাম হমারা, মুসলমান রহিমানা/ আপসমে দৌউ লড়ে মরতে হৈ, মরম কোই নেহি জানা।’ অর্থাৎ, হিন্দু বলে রাম আমার, মুসলমান বলে রহিম আমার। একে অপরের সঙ্গে লড়ে মরে, অথচ মর্ম কেউ জানলো না।

ভারতবর্ষের সূফিরা হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কবীরের বাণীগুলোতে হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক সেতুরূপে সুফি চিন্তাধারার গুরুত্বের জন্য অনেকে কবীরকে সূফি মতাবলম্বী বলে থাকেন। জে. এন. ফরখারের মত হচ্ছে, ‘সুফিদের চিন্তার মাধ্যমেই ইসলাম হিন্দু-হৃদয়ে পৌঁছায়। যিনি ঐ চিন্তাধারার মূল জিনিসগুলোকে দিলেন সাধারণ মানুষের কাছে, তিনি কবীর।’ অপরদিকে কবীরকে চিশতিয়া সম্প্রদায়ের শিষ্য এবং সূফি-সন্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন গবেষক মুহম্মদ এনামুল হক।

কিন্তু ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব সূফিবাদ থেকে কবীরের দূরত্বের প্রতি জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে কবীরের কাছাকাছি সময়ে তাঁর পরিচয় সূফি হিসেবে নয়, মুওয়াহিদ বা একেশ্বরবাদী রূপে।’ পণ্ডিত ক্ষীতিমোহন সেনের ‘কবীর’ গ্রন্থের প্রাককথনে সব্যসাচী ভাট্টাচার্য লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে পণ্ডিতেরা একমত যে, কবীর-দর্শনকে সম্প্রদায়ের গণ্ডীর মধ্যে বর্গীকরণ করা সহজ নয় এবং সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমান ভেদবোধের বিরুদ্ধাচারণ কবীরপন্থার বিশেষ লক্ষণ।’  

হিন্দুধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত কাশী বা বারাণসী। বিশ্বনাথের এই প্রাচীন মন্দির গঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। কাশী বিশ্বনাথের মন্দির বিশ্বেশ্বর মন্দির নামেও পরিচিত। কাশীতে মৃত্যু হলে জন্ম-মৃত্যুর বৃত্তাকার চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে মনে করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এখানে যার মৃত্যু হয়, স্বয়ং মহাদেব তার কানে তারকমন্ত্র দেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

প্রচলিত এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কবীর। চিরদিন তিনি কাশীতে ছিলেন। মৃত্যুর আগে বললেন, ‘আমাকে কাশী থেকে দূরে নিয়ে চলো।’ শিষ্যরা তাঁকে বস্তী জেলার মগহরে নিয়ে গেল। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর হিন্দু রাজা বীরসিংহ ও মুসলমান রাজা বিজলী খাঁর মধ্যে লাগল বিবাদ। বীরসিংহ চান কবীরকে হিন্দুমতে দাহ করতে, আর বিজলী খাঁ চান কবর দিতে। ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও কথিত আছে যে, কবীরের কাফনের কাপড় খুলে দেখা গেল সেখানে কবীর নেই, কতগুলো ফুল পড়ে আছে। সেসব ফুলের অর্ধেক নিয়ে মুসলমান ভক্তরা মগহরে কবর দিল, বাকি অর্ধেক হিন্দুরা কাশীতে এনে দাহ করল। চলবে

৪ আগস্ট ২০২২