স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৭৭

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২

মধ্যযুগের প্রভাবশালী পদকর্তা দাদূ তো কোনো জাতপাত মানতেন না। তিনি বলতেন, ‘নির্ভয় হও, উদ্যমী বীর হও, সম্প্রদায়বুদ্ধি ত্যাগ করো। তীর্থ, ব্রত, মূর্তিপূজা, বাহ্য আচার ও চিহ্ন ধারণ সব ব্যর্থ। ক্ষমাশীল হও, ভগবদ-বিশ্বাসে দৃঢ় হও।’ একবার এক হিন্দু সন্ন্যাসী ও এক মুসলিম মৌলবি এসে দাদুকে বললেন, ‘দাদু, আপনি সাধনার কথা বলেন, ঈশ্বরের আরাধনা করেন, মানুষের সেবা করেন—সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত?’ দাদু মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা ভাই, সূর্য, পৃথিবী, আকাশ ও নদী হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সেবা করে চলেছে, আপনারা কখনও জানার চেষ্টা করেছেন তারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত?’

আকবর তখন ভারতসম্রাট। ভারতীয় ভাবসাধকদের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ। তাঁদের কাছ থেকে তিনি জ্ঞানের কথা শোনেন, ভাবের কথা শোনেন। তখন সাধক দাদূর নাম ফিরছে মানুষের মুখে মুখে। শত শত মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করছে। একদিন দাদুর নাম পৌঁছল সম্রাট আকবরের কানেও। তিনি দাদূর সঙ্গে দেখা করতে চান। দূত পাঠালেন দাদূর কাছে। দূত গিয়ে দাদূকে বললেন, ‘সম্রাট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি অবিলম্বে দরবারে উপস্থিত হলে তিনি খুশি হবেন।’ দাদূ বললেন, ‘ভাই, সম্রাটের আমন্ত্রণে আমি সম্মানিত। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার সঙ্গে দেখা করলে তাঁর কী লাভ হবে। দেখা করতে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তুমি তাঁকে বুঝিয়ে বলো যে তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’

দূত ফিরে গিয়ে সম্রাটকে জানালেন দাদূর এই কথা। সম্রাট বুঝলেন, এভাবে আমন্ত্রণ জানালে দাদূ আসবেন না। তিনি সুন্দর একখানা আমন্ত্রণপত্র লিখে আবার দূতকে পাঠালেন। বললেন, ‘তুমি এই পত্রখানা দাদূর হাতে দিয়ে বলবে, ভগবৎ-জ্ঞান পিপাসু আকবর আপনার দর্শনপ্রার্থী। কবে, কোথায় দেখা হতে পারে আপনি দয়া করে বলুন।’ দূত আবার দাদূর কাছে গিয়ে পত্রখানা দিলেন এবং সম্রাটের কথাগুলোও বললেন। দাদূ পত্রখানা খুলে পড়লেন।

সম্রাট লিখেছেন, ‘হে মহাত্মা, রাজধানীর কঠিন বাস্তবতার মধ্যে আপনাকে ডেকে আনার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সাগর থেকে একপাত্র জল নিয়ে এসে কি সাগরকে বোঝা যায়? আবার আমিও যে আপনার কাছে যাব, সেটাও সম্ভব নয়। কারণ আমার দুর্ভাগ্য যে আমি দেশের সম্রাট। আমি আপনার ওখানে গেলে যে আলোড়ন হবে তাতে আমরা দুজনেই অস্বস্তিতে পড়ে যাব। তাই কোনো নির্জন স্থানে, লোকচক্ষুর আড়ালে আপনার দর্শন পেতে চাই। আশা করি আমার এই আকাক্সক্ষা থেকে আপনি আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’

দাদূ এবার রাজি হলেন। ফতেপুর সিক্রির কাছে এক নির্জন প্রান্তরে সম্রাট ও দাদূর দেখা হলো। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর জমে উঠল দুজনের আলাপ। ভাবসাধন বিষেয়ে কৌতুহলী আকবর নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন দাদূকে। জানতে চাইলেন, ‘সবাই বলে আপনি নাকি কোনো শাস্ত্র মানেন না। আসলে আপনার শাস্ত্র কী? সাধনার পদ্ধতি বা মন্ত্রই বা কী? আপনি কোন পথের সাধক?’ দাদূ হাসলেন। বললেন, ‘সম্রাট, আমি আমার শরীরের মধ্যে নামাজ পড়ি, যেখানে কোনো জনপ্রাণী প্রবেশ করতে পারে না। চিত্তসাগরে স্নান করে মনের মালা দিয়ে জপ করি, তারপর নির্মল চিত্তখানি প্রভুর চরণে সমর্পণ করে তাঁর বন্দনা করি। এটাই আমার সাধন পদ্ধতি, এটাই আমার শাস্ত্র।’

সম্রাট বললেন, ‘মহাত্মা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনো প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হলো? আগে কে এসেছে বিশ্বে? আকাশ, বায়ু, জল না ভূমি?’ খানিক হেসে দাদূ বললেন, ‘সে কী সম্রাট! আপনার স্রষ্টাকে আপনি এত সীমিত ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যার সৃষ্টি, সর্বশক্তির যিনি আধার, তার কাছে কোনটা আগে বা কোনটা পরে—এ প্রশ্ন কি অবান্তর নয়?’

আকবার অবাক হলেন। কঠিন কথাকে কত সহজ করে বললেন দাদূ! কথিত আছে যে, সাধক দাদূর সঙ্গে সম্রাট আকবরের আলাপ হয় চল্লিশ দিনব্যাপী। তার বিবরণ দাদূর শিষ্যরা লিখে রেখেছেন। দাদূর ভাবদর্শনে বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন আকবর।

উদার ও সমন্বয়বাদী সাধক দাদূ ছিলেন সন্ত কবীরের ভাবদর্শনে প্রভাবিত। ইতোপূর্বে লিখেছি যে, সন্ত কবীর সনাতন ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে সংঘর্ষের পরিবর্তে ঐক্যের প্রতি জোর দিয়েছিলেন। দুই ধর্মের অর্থহীন আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডগুলোকে তিনি আক্রমণ করেন এবং দুই ধর্মেরই পরম লক্ষ্য যে এক ও অভিন্ন, তা তাঁর দোঁহা তথা বাণীর মাধ্যমে প্রচার করেছেন। একদিকে তিনি যেমন কুসংস্কারমূলক ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করেছেন, অন্যদিকে জোর দিয়েছেন আচরণে কঠোর নীতিনিষ্ঠার ওপর।

তিনি ছিলেন হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথার কঠোর সমালোচক। প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের অবতারবাদের বিরুদ্ধে, পুণ্যসলিলা নদীসমূহে স্নান করলে স্বর্গলাভ হয়—এই সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধে তিনি অবিরাম লড়াই করেছেন। দাদূও তাই করেছেন। ভারতবর্ষে তো তখন জাতপাতের ভেদাভেদ চরমে। মরমী সাধক দাদূ তাঁর উদার ‘পদ’ বা ‘বাণী’র মাধ্যমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন জাতপাতের দেয়াল।

কবীরপরবর্তী আন্তঃধর্মীয় ঐক্য বিষয়ে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী সাধকদের একজন হচ্ছেন দাদূ। কবীরের মতো সকল ধর্মের ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রহ্মসম্প্রদায়’ বা ‘পরব্রহ্মসম্প্রদায়’। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি ছিল মুসলমানরাও। আজও তাই আছে। হিন্দু-মুসলমান ও সকল ধর্মকে এক উদার ও মৈত্রীভাবের দ্বারা যুক্ত করার এক বড় আকাক্সক্ষা ছিল দাদূর। তাঁর পদ বা বাণীগুলো গভীর ও উদার। পদগুলোতে তিনি বারবার সন্ত কবীরের গুণগান করেছেন। কারো মতে, কবীরপুত্র কমালের শিষ্য ছিলেন দাদূ।

দাদূর জন্ম ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে। কারো মতে তাঁর জন্ম কাশীতে, মুচি বা চর্মকার বংশে। কারো মতে তাঁর জন্ম গুজরাতের আমেদাবাদে। তাঁর অনেক শিষ্য প্রমাণ করতে চান যে, তাঁর জন্ম নাগর ব্রাহ্মণ বংশে। দাদূ ছিলেন তুলা-ধুনকর। ধুনকরদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানই দু-দলই ছিল। দাদূ ছিলেন মুসলমান। তাঁর পূর্বনাম ছিল দাউদ। স্ত্রীর নাম ‘হবা’ বা ‘হাওয়া’, দুই পুত্রের নাম গরীব দাস ও মসকীন দাস এবং দুই কন্যা হচ্ছেন নানী বাঈ ও মাতা বাঈ। দুই কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল দাদূর। কিন্তু কন্যারা ব্রহ্মচারিণী হয়ে সাধনা করতে আগ্রহী।

কবীরের মতো দাদূরও কোনো শাস্ত্রপ্রীতি ছিল না। আত্মানুভবকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সত্য অজেয়, সত্য জীবনে লুকানো যায় না। অহংকার ত্যাগ করো। সকল মানুষ পরষ্পরের ভাই। এক ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে সকলকে ভাইবোনের মতো দেখো। তোমার অন্তরেই ভগবানের ধাম, সেখানেই তাঁর নিবাস। প্রেমের মাধ্যমে সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়। ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হও। তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা না করে বরং তাঁর বিশ্বসেবার সঙ্গে নিজের সেবাকে মিলাও, তাহলেই গভীতর হবে যোগ। দুর্নীতি, মলিনতা ত্যাগ করে সরলভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন হওয়ার নাম যোগ।’ দাদু বলেছেন, ‘মহারো লাগি রাম বৈরাগী তজা নঁহী জাঈ/প্রেম বিথা করত উর অন্তর বিসুরি সুখ নঁহী পাঈ।’ অর্থাৎ আমার জন্য রাম বৈরাগী, তাই তাঁকে ত্যাগ করার কোনো উপায় নেই। অন্তর আমার প্রেমের বেদনায় আর্ত, তাঁকে বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই।

সপরিবারে দাদূ তখন রাজপুতানার ‘আম্বের’ এলাকায় বসবাস করছিলেন। আম্বের তখন জয়পুরের রাজা ভগবন্তদাসের অধীনে। রাজা ভগবন্তদাস শিল্পানুরাগী ও ধার্মিক হলেও তাঁকে ঘিরে যারা থাকতেন তারা তাকে সৎবুদ্ধি  দেওয়ার বদলে স্তাবকতা করত, যার ফলে খুবই অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন রাজা। আম্বেরে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি এলে তিনি রাজার সঙ্গে দেখা করতেন ও রাজার অনুগ্রহ চাইতেন। এটাই ছিল ভগবন্তদাসের রাজ্যের অলিখিত নিয়ম।

দাদূ এই নিয়ম ভঙ্গ করলেন। আম্বেরে আসার পর তিনি একবারও রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন না। এমনকি রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েও যাননি। ক্রমে দাদূর খ্যাতির কথা রাজার কানে পৌঁছল। রাজা একটু অবাক হলেন। এত বড় একজন সাধক তাঁর রাজত্বে এসে তাঁর সঙ্গে কিনা দেখা করলেন না! রাজার স্তাবকেরা বলল, ‘মহারাজ, এই সাধকের খুব অহঙ্কার। সম্রাট আকবর তার সঙ্গে দেখা করেছেন বলে তার পা মাটিতে পড়ে না।’ রাজা মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেন। কে এই সাধক? তিনি কত বড় যোগীপুরুষ, নিজে আশ্রমে গিয়ে দেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।

একদিন দাদূর আশ্রমে গেলেন রাজা ভগবন্তদাস। দাদূ তখন চোখ বুজে ভজনগান করছিলেন। রাজা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও দাদূ তাকে দেখতে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর গান শেষ করে রাজাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘এই আশ্রমে রাজার আগমনে আমার ভক্ত-শিষ্যরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে।’ রাজা বললেন, ‘কেন, আপনি খুশি হননি?’ দাদূ বললেন, ‘প্রেমময় প্রভুর প্রেমে তো আমি চিরখুশি। আমার তো কোনো দুঃখবোধ নেই।’

রাজা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আপনি কবে এ রাজ্যে এসেছেন? আমার সঙ্গে তো আপনার দেখা হয়নি?’ মৃদু হেসে দাদূ বললেন, ‘আমি অনেকদিন হলো এ রাজ্যে এসেছি, রাজ্যের অনেক মানুষের সঙ্গেই আমার এখনো দেখা হয়নি।’ দাদূর কথায় রাজা খুব রেগে গেলেও রাগ প্রকাশ করলেন না। তখন দাদূর দুই কন্যা রাজাকে আপ্যায়ন করার জন্য ফলফলাদি নিয়ে এলো। তাদের দেখে রাজা কাটাক্ষ করে বললেন, ‘আপনার মেয়েরা তো বিবাহযোগ্যা, এখনো আপনি এদের বিয়ের কথা ভাবেননি?’ কটাক্ষ বুঝতে পারলেন দাদূ। তবু শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘জো পতি বর্যো কবীরজী, সো করি বর্যে নিচাহি।’ অর্থাৎ কবীর যাঁকে পতিত্বে বরণ করে নিয়েছেন, আমার মেয়েরাও তাঁকেই পতিরূপে গ্রহণ করেছে, তাই এক অর্থে তারা বিবাহিত।

রাজা ভগবন্তদাস আর কোনো কথা না বলে আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। দাদূও আর অহংকারী ভগবন্তদাসের রাজ্যে রইলেন না। আম্বের ছেড়ে চলে গেলেন রাজপুতানার নারয়না এলাকায়। সেখানেই কাটান জীবনের অন্তিম দিনগুলো সাধনা করে এবং ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই দেহত্যাগ করেন। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক