স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৭৮

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২

ইরানের নারীরা চুল কেটে পতাকা বানিয়ে ওড়াচ্ছেন, হিজাব খুলে আগুনে পোড়াচ্ছেন, ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর জন্য এটা এক সতর্কবার্তা। ধর্ম যত বেশি কঠোরতা প্রদর্শন করবে, ধর্মহীনতা তত বেশি উৎকর্ষ লাভ করবে। বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশে ধর্মহীনরা সংখ্যাগুরু, ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, সেসব দেশে ধর্মের কঠোরতা এবং ধর্মের নামে অরাজকতা ছিল বেশি। ধর্ম একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার, মানুষের ব্যক্তিগত সাধনা। একে যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলানো হয়, যখন জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই ঘটে এর বিকৃতি, তখনই শুরু হয় সামাজিক বিকার।

নৈতিকতা পুলিশ কর্তৃক মাইশা আমিনি হত্যার ঘটনায় ইরানে চলমান বিক্ষোভে এই পর্যন্ত প্রায় দশজন, কোনো কোনো সূত্র মতে প্রায় ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ৫০টিরও বেশি শহরে। আন্দোলন দমাতে সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ইন্টারনেট। বন্ধ করে দিয়েছে ইন্সট্রাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কুর্দি অধ্যুষিত কোনো কোনো এলাকায় বন্ধ করে দিয়েছে ফোনসেবাও।

তাতে কি আন্দোলন দমানো যাবে? মনে হয় না। কারণ ইরানের অধিকাংশ মানুষ বুঝে গেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কী জিনিস, এর প্রয়োজন কতটুকু। আশির দশকে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর যখন নারীর পোশাকের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় তখনই বিক্ষোভ হয়েছিল, বিক্ষোভ করেছিল ইরানের বিস্তর নারীপুরুষ। কিন্তু তারা তখন হালে পানি পায়নি। সরকার শরিয়া প্রয়োগ করে কঠোর হাতে তাদের দমন করেছে।

এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ক্ষমতাসীনদের দুঃশাসন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ নানাবিধ কারণে যজ্ঞকুণ্ড আগেই প্রস্তুত ছিল। মাইশা আমিনি হলেন সেই কুণ্ডে দেশলাইয়ের একটি কাঠি। সেই কাঠির আগুনে গোটা কুণ্ডে ধরে গেছে আগুন। দাউদাউ করে জ্বলছে ইরান। সেই প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে বহু দিনের শত্রু আমেরিকা। ইরানকে শায়েস্তা করতে নানাভাবে চেষ্টা করছিল আমেরিকা। সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। এবার একটা সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগের সুফল তারা ঘরে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।


মানুষ স্বভাবতই পরিবর্তনশীল প্রাণী। সে প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করে। আদিম সমাজ ব্যবস্থা থেকে পরিবর্তন সাধনের মধ্য দিয়েই মানুষ আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে। এই সমাজও দীর্ঘকাল থাকবে না, আবার বদলাবে। কেননা পরিবর্তনই মানুষের চিরায়ত সংস্কৃতি, পরিবর্তনই প্রকৃতির ধর্ম। এই জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনকে স্বীকার না করা মানে পেছনে পড়ে যাওয়া। পেছনে পড়ে যাওয়া মানুষের পাশে কেউ থাকে না। তাকে ঘিরে ধরে নানা বিপদ। সেই বিপদের বিরুদ্ধে সে একা লড়তে পারে না। তার পতন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম প্রধান দেশ বদলে গেছে। ইসলামের উৎপত্তির দেশ সৌদি আরবে তো অনেক আগেই লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। কট্টরপন্থি দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদিকে রক্ষণশীলতার খোলস থেকে বের করে মধ্যপন্থি, উন্মুক্ত ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছেন ক্ষমতাসীন আল সৌদ পরিবার। দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে খোলনলচে বদলাচ্ছেন তারা। দেশকে নয়া উদারনীতির পথে এগিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তার কথায়, ‘আগে যেমন ছিল, সে রকম উদারনীতিতেই ফিরে যাবে সৌদি আরব। বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের জন্য আমাদের দরজা খোলা।

নারী অধিকারের প্রশ্নে রক্ষণশীল সৌদি পাল্টে ফেলেছে নিজেকে। নারীদের প্রার্থী ও ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি এবং সিনেমা হলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তুলে নিয়েছে হিজাব ও বোরকা পরার বাধ্যবাধকতা। সৌদি আরব গড়ে তুলছে যাবতীয় ধর্মীয় সংস্কার ও বিধি-নিষেধ মুক্ত শহর ‘নিওম’। কোনো বিধিনিষেধ নয়, কোনো বিভাজন নয়, কোনো অজুহাতও নয়, সৌদি আরব উন্নীত হচ্ছে উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক রাষ্ট্র হিসেবে।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান মুসলিম দেশ আরব আমিরাত তো অনেক আগেই নিজেদের বদলে ফেলেছে। সাংস্কৃতিক উদারতার কারণে দেশটি হয়ে উঠেছে বিশ^বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, বিনোদনের অন্যতম তীর্থস্থান। বহুত্ববাদ চর্চার অংশ হিসেবে আবুধাবিতে তৈরি হয়েছে দেশটির প্রথম হিন্দু মন্দির।

পরিবর্তিত এই মুসলিমবিশ্বে ধর্মীয় কঠোরতা আর চলবে না, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আর চলবে না, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে দমিয়ে আর চলবে না। আফগানে তালেবান সরকার ধর্মীয় প্রশ্নে যত বেশি কঠোর হবে, ততই বাড়বে আভ্যন্তরীণ সংকট, অর্থনৈতিক সংকট। বাড়তে থাকবে দারিদ্র, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মরতে থাকবে মানুষ। পাকিস্তান তো ধর্মান্ধতার বদ্ধকূপে রীতিমতো ধুঁকছে। ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে তারা। কিন্তু ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রে ধর্মান্ধতার যে বিষবৃক্ষ শিকড় গেঁড়ে বসেছে, তা কিছুতেই তারা উপড়াতে পারছে না।

এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইরানে হিজাব বিরোধী ও নারী স্বাধীনতা আদায়ের যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা সহজে দমবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রচলিত গ্রামীণ প্রবাদ, ‘নাট বেশি টাইট দিলে লুস হয়ে যায়।’ ইরানেও হয়েছে সেই দশা। ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কঠোরতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছে দেশটি। ফেরদৌসী, ইবসে সিনা, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, আল বিরুনি প্রমুখ উদারপন্থি মুসলিম মরমী কবি ও মনীষীর দেশ ইরান আবার ফিরে পাক তার হারানো উদার ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্য। ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতার বিনাশ হোক। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক