স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৭৯

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২২

জনপ্রিয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলোর একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ আছে। সেই ছাঁচ অনুযায়ী গল্প লিখতে হবে, উপন্যাস লিখতে হবে। আইসক্রিমের যেমন। আইসক্রিমে ছাঁচে পানি, দুধ, নারিকেল ইত্যাদি দিয়ে হিমাগারে রাখলে আইসক্রিম তার নির্দিষ্ট আকার পায়। সেই আকার দেওয়ার জন্য কসরত করতে হয় না, প্রতিমাশিল্পী যেমন করেন। প্রতিমার কোনো ছাঁচ নেই। হয় না। কাদামাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ে নিতে হয়। গড়ে নিতে হয় বলেই সেটা শিল্পকর্ম।

দৈনিকের ছাঁচটি কেমন? এই ছাঁচের গল্প-উপন্যাসে রাজনীতি থাকা যাবে না, অশ্লীল শব্দ থাকা যাবে না, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার থাকা যাবে না, রাষ্টের কোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনা-কটাক্ষ-বিদ্রুপ করা যাবে না, বিচারালয় নিয়ে লেখা যাবে না, সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগ নিয়ে লেখা যাবে না, অনুভূতির রাজনীতিতে আঘাত করা যাবে না, শব্দসংখ্যা এক বা দুই হাজারের বেশি হওয়া যাবে না ইত্যাদি।

এসব ‘না’-কে বাদ দিয়ে যে গল্প-উপন্যাস সেটাই দৈনিকের সাময়িকীতে প্রকাশযোগ্য। নয় তো না। কারণ এটা তাদের ব্যবসা। তাদের ভোক্তাসাধারণও এমনটাই চায়। চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করাই সম্পাদকের কাজ। এখানে লেখকের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, সম্পাদক তাকে যতটুকু স্বাধীনতা দেবেন, ততটুকুই তিনি ব্যবহার করতে পারবেন। এর বাইরে একটুও নয়।

হ্যাঁ, সাহিত্যিক যখন দৈনিকের জনপ্রিয়তাকে ডিঙিয়ে নিজেই অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন, তখনো কোনো কোনো দৈনিক আগ্রহী হয় তার গল্প-উপন্যাস প্রকাশে। আগ্রহী হয় লেখকের জনপ্রিয়তার কারণে, সাহিত্য-গুণের কারণে নয়। তখন সাহিত্যিক যা লিখবেন তা সম্পাদনা ছাড়াই তারা ছাপে। এখানেই লেখকসত্তার কাছে প্রতিষ্ঠানের পরাজয় ঘটে।

দৈনিক বলতে সত্যিকারের খবরের কাগজকে বোঝানো হচ্ছে, পুঁজির প্রহরী কাম খবর কাগজকে নয়। দৈনিকের সাময়িকীগুলো সাহিত্যের নামে নামে ছোট ছোট ঢিবি তৈরি করে। সেটাই তাদের কাছে সাহিত্য। তাদের ভোক্তাদের কাছেও। কেউ যদি সাহিত্যের সুউচ্চ মাউন্ট এভারেস্ট তৈরি করে দৈনিকের সাময়িকীতে ছাপতে চায়, সম্পাদক তা ছাপবে কেন? পাঠক পড়বেই-বা কেন?

যেসব সাহিত্যিক নিজের সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে অপরের দেওয়া স্বাধীনতা ভোগ করতে চান, তাদের উদ্দেশে কথাশিল্পী অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেন, ‘লেখকের অবাধ স্বাধীনতা যদি না থাকে, লেখককে যদি রাজনৈতিক কারণেই হোক বা অর্থনৈতিক কারণেই হোক নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে কোনও পত্রিকায় লিখতে হয়, তাহলে তার লেখা উচিত নয়, আত্মহত্যা করা উচিত।

তাই বলে দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলো বন্ধ করে দিতে হবে? না, তা মোটেই না। অমিয়ভূষণ মজুমদার একটু বেশিই কঠোর হয়েছেন। হওয়াটা অবশ্য স্বাভাবিক। সারাজীবন কেন্দ্র থেকে বহু দূরে থেকেছেন, সদূর কোচবিহারে। চিরকাল আনন্দবাজার, দেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের উপেক্ষার শিকার হয়েছেন। সে-কারণেই হয়তো তাঁর বক্তব্যটি এতটা কঠোর, সেকারণেই বুঝি তিনি স্বাধীনতা ও সত্তা বিসর্জনকারী লেখকদের না লিখে আত্মহত্যার পরামর্শ দিয়েছেন। এতটা কঠোর না হয়ে তিনি এভাবে বলতে পারতেন যে, ‘স্বাধীনতা ও সত্তা বিসর্জনকারী লেখকরা না লিখে কাঁচা তরিতরকারির ব্যবসা করা উচিত।’ এভাবে বললে বক্তব্যের কঠোরতা কিছুটা হৃাস পেত।

দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলো একটি দেশের সারস্বত সমাজ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা বিস্তর। কিন্তু হাতেগোনা তিন-চারটি ছাড়া সত্যিকারের দৈনিক পত্রিকা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ দৈনিক পুঁজিপতিদের পুঁজি রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অধিকাংশ সাংবাদিক পুঁজিপতিদের পাহারাদারের ভুমিকায়। অধিকাংশ পত্রিকার সাংবাদিক ‘মারিং-কাটিং-পেস্টিং’ ধরনের সাংবাদিক। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি দৈনিকের সাহিত্যপাতা রয়েছে। একটা সময় দেশের বড় বড় কবি-সাহিত্যিক সাহিত্যপাতা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের হাত দিয়ে অনেক ভালো সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়েছে সেসব সাময়িকীতে। বাংলাদেশের বিস্তর তরুণ কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য সাময়িকী পড়তে পড়তে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়েছেন। সাময়িকীগুলো তাদেরকে নানাভাবে সাহিত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। পনেরো-কুড়ি বছর আগেও বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরের হাজার হাজার তরুণ ছিলেন, যারা শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতেন। তারা ছিলেন সাহিত্য সাময়িকীগুলোর মনোযোগী পাঠক।

এখনো দেশের অসংখ্য তরুণকে চিনি, যারা প্রতি শুক্রবার সবকটি পত্রিকা সংগ্রহ করেন। সংগ্রহ করতে না পারলেও নানাভাবে পড়ার চেষ্টা করেন। কোন পত্রিকার কোন সাময়িকীতে কী লেখা, কার লেখা ছাপা হলো, সব পড়ার চেষ্টা করেন। লাইব্রেরী সংকট, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রান্তের একজন তরুণ সাহিত্যকর্মী সবসময় সব বই সংগ্রহ করতে পারেন না, পড়তে পারেন না। সেক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীগুলো তাদের পাঠক্ষুধা কিছুটা হলেও মেটায়। এসব সাময়িকীকে তাঁরা সাহিত্যচর্চার অন্যতম মাধ্যম বলে মনে করেন।

দেড় দশক আগেও সাহিত্য সাময়িকীগুলোর জৌলুস ছিল। কোনো কোনো দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী ছিল চার পৃষ্ঠার। কমতে কমতে এখন অধিকাংশ পত্রিকার সাহিত্য পাতা এক পৃষ্ঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। এক পৃষ্ঠায় এমন কী আর ছাপা যায়? ঠিকমতো একটা গল্প কিংবা একটা প্রবন্ধও না। দৈনিকগুলোর সবচেয়ে উপেক্ষিত বিভাগটির নাম হচ্ছে সাহিত্য বিভাগ। অফিসে সবচেয়ে গুরুত্বহীন পদটির নাম হচ্ছে সাহিত্য সম্পাদক। সবচেয়ে বেতন কম কার? সাহিত্য সম্পাদকের। চাঁটাই করতে হলে কাকে আগে চাটাই করতে হবে? সাহিত্য সম্পাদককে। হঠাৎ বিজ্ঞাপন এসে গেলে কোন পাতা স্থগিত করে বিজ্ঞাপন ছাপতে হবে? সাহিত্য পাতা।

এছাড়া সাহিত্য পাতায় যার লেখেন তাদেরকে ঠিকমতো দেওয়া হয় না লেখক সম্মানী। কয়েকটি পত্রিকা নিয়মিত দেয়, অধিকাংশই দেয় না। তারা মনে করে, লেখা ছাপা হয়েছে এই তো বেশি, আবার সম্মানী কিসের? তারা পত্রিকার কাগজের টাকা দেবে, ছাপার টাকা দেবে, প্রুফ রিডারের টাকাও দেবে; কিন্তু লেখকের টাকা দিতে তাদের কার্পণ্য। পৃষ্ঠাসজ্জার জন্য শিল্পীর সম্মনীও ঠিকমতো দেয় না। ফলে দৈনিকগুলোতে সত্যিকারের লেখকরা লিখতে আগ্রহ পান না, সম্পাদকরা ভালো লেখা সংগ্রহ করতে পারেন না।

সাহিত্য জগতে প্রবেশের অনেক দরজা রয়েছে। দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলো একেকটি দরজা। সাহিত্যের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট করতে সাহিত্য সাময়িকীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সবগুলো মাধ্যম তো বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাহিত্য সাময়িকীগুলোও বন্ধ হওয়ার দুয়ারে দাঁড়িয়ে। একটি দেশের সাহিত্যচর্চার জন্য এটি মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। পুঁজিপতিদের উচিত ভর্তুকি দিয়ে হলেও সাহিত্য সাময়িকীগুলোর প্রকাশ অব্যাহত রাখা। সম্পাদকদের উচিত সাহিত্য সাময়িকীগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। সব কটি দরজা বন্ধ করে দিলে প্রজন্মের চিন্তা জগৎ সমৃদ্ধ হবে কেমন করে? তারা তো পথ হারাবেই। চলবে