স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮০

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৭, ২০২২

জগৎ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের তো একটা নিজস্ব দর্শন থাকতে হয়। দর্শনটি নিজেকেই আয়ত্ব করে নিতে হয়। সেটা কেউ তাকে বলে দেবে না, কেউ শিখিয়ে দেবে না। দর্শনহীনতা লেখককে দোদুল্যমান করে তোলে। সেই দোদুল্যমানতার ছাপ পড়ে তার লেখায়। বোঝা যায়, স্পষ্টই বোঝা যায়।

মহর্ষি বাল্মীকির একটা দর্শন ছিল। রাবণের সম্পূর্ণ চরিত্র আঁকতে তাঁর মধ্যে কোনো সংকোচ ছিল না, দ্বিধা ছিল না, কার্পণ্য ছিল না। দশটি মাথা দিয়েছেন রাবণকে। দশানন করেছেন। জ্ঞানী করেছেন, সর্ববিদ্যা বিশারদ করেছেন। কিন্তু বাল্মীকির দর্শন ছিল ধর্মের পক্ষে। ধর্ম মানে রিলিজিয়ন নয়। ইউরোপের রিলিজিয়ন ও ভারতবর্ষের ধর্ম বা বাংলার ধর্ম এক নয়। বাল্মীকির ধর্ম মানে রিলিজয়ন নয়, ঈশ্বর বিশ্বাস নয়। তাঁর ধর্ম মানে ন্যায় ধর্ম, রাজধর্ম, লোকের আচরিত জীবনধর্ম। তাঁর পক্ষাবলম্বন সেই ধর্মেরই পক্ষে। তিনি না বললেও সেটা সহজেই বোঝা যায়।

বেদব্যাসেরও কি নির্দিষ্ট দর্শন ছিল না? তাঁর মহাকাব্যে কোন চরিত্রকে তিনি খাটো করেছেন? করেননি তো। প্রত্যেককে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলভাবে এঁকেছেন। মহামহিম ভীষ্মকে যতটা মহান করার দরকার, করেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের যা প্রাপ্য, তা দিয়েছেন। দুর্যোধনের প্রতি যতটা সহানুভূতি দেওয়ার, দিয়েছেন। কিন্তু তিনি না বললেও পাঠক হিসেবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তার পক্ষাবলম্বন ছিল ধর্মের প্রতি। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবদের তিনি ধর্মের প্রতীক করেছেন। তাদের মধ্য দিয়েই তিনি ধর্মকে (রিলিজিয়নকে নয়) মূর্ত করেছেন।

হোমারেও দেখি সেই দার্শনিক অবস্থান। হেক্টরকে তিনি কম সহানুভূতি দেননি, কম মহিমান্বিত করেননি। হেক্টরবধের পর শোকাকুল পরিস্থিতি তৈরি করতে কোনো কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তাঁর পক্ষপাত ছিল একিলিসের প্রতি। সেই সুপ্ত পক্ষপাত পাঠক হিসেবে আমাদের নজর এড়ায় না।

অমিয়ভূষণ রাজনীতি করতেন না, রাজনীতির ব্যাপারে তিনি সদাই নিশ্চুপ থাকতেন। কেউ রাজনীতি বিষয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁর লেখায় কি রাজনীতি নেই? রাজনৈতিক দর্শন নেই? গড়শ্রীখণ্ড, মধুসাধু খাঁ, নয়নতারা, মহিষকুড়ার উপকথায় কি রাজনীতি নেই? রাজনৈতিক দর্শন নেই? আছে, প্রবলভাবেই আছে। তিনি তাঁর পক্ষপাতকে ব্যক্ত করেছেন নানা উপন্যাসে, নানা আঙ্গিকে। তিনি না বললেও আমরা বুঝতে পারি।

মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর, দেবেশ রায়, শওকত ওসমান, শওকত আলী, সিরাজ, হাসান, ইলিয়াস প্রমুখ―এঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দর্শনে ক্লিয়ার ছিলেন। সেই দর্শন পাঠক হিসেবে আমার ভালো না-ও লাগতে পারে, আমি তা না-ও মানতে পারি। কিন্তু এটা মানতে হবে যে, তারা দোদুল্যমান ছিলেন না, তাঁদের একটা নির্দিষ্ট দর্শন ছিল, নির্দিষ্ট অবস্থান ছিল।

লেখকের এই দর্শনটা কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে? না, বহু শতাব্দী ধরে আর আকাশ থেকে কিছু আসছে না। লেখকের দর্শন আসবে অগ্রজদের কাছ থেকে, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, পুরাণের কাছ থেকে, ইতিহাসের কাছ থেকে। লেখকের দর্শন আসবে অবিরাম পাঠের মধ্য দিয়ে। কেবল বই পাঠ নয়, জগৎ ও জীবনকে পাঠ। সেই জগৎ কেবল মানুষের জগত নয়, সেই জীবন কেবল মানুষের জীবন নয়; মানবেতর প্রাণীরও জগৎ, মানবেতর প্রাণীরও জীবন। লেখককে অন্তত এই বিষয়ে ক্লিয়ার থাকা দরকার যে, এই পৃথিবী কেবল মানুষের একার নয়। এই পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আমার যেটুকু অধিকার, একটা পিঁপড়ারও সেটুকু অধিকার।

আমি উপন্যাস লিখি, কিন্তু হোমারকে পড়ব না, বেদব্যাসকে পড়ব না, বাল্মীকিকে পড়ব না; স্তাঁদাল, ফকনার, কাফকা, কামু, হেমিংওয়ে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, জোলা, মার্কেসকে পড়ব না; ওয়ালীউল্লাহ্, দেবেশ, সিরাজ, সৈয়দ হককে পড়ব না, তাহলে কেমন করে গঠিত হবে আমার দর্শন? আমি বাঙালি কথাকার, বাংলায় কথা লিখি, অথচ বাঙালির হাজার বছরের জার্নিটা জানব না, বাঙালির গ্রহণ-বর্জনের ক্ষমতাকে জানব না, বাঙালির উদারতা ও সম্বয়বাদীতার ইতিহাস জানব না, বাঙালির প্রতিহিংসা আর আত্মঘাতের চরিত্র জানব না, বুঝব না―তাহলে কী করে গঠিত হবে আমার দর্শন?

যখন লেখককে দেখি প্রচল স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন, সেই স্রোত যখন যেদিকে যাচ্ছে তিনিও সেদিকে যাচ্ছেন, বসন্তের ঝরা পাতার মতো, তখন ভাবি, কেমন করে তিনি লেখেন? কী লেখেন? তার তো কোনো দর্শন নেই, তার তো কোনো অবস্থান নেই। কীভাবে লেখা আসে তাঁর? কোথা থেকে আসে?

একটা জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জিম্মাদার হচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। আর লেখকরা হচ্ছেন ভাষা ও সংস্কৃতির জিম্মাদার। লেখকদের মধ্যে যখন দর্শনহীনতা দেখা দেয়, তখন বামনদের রাজত্ব শুরু হয়। শরীরে নয়, মেধায় বামন, জ্ঞানে বামন, দর্শনে বামন। সেই রাজত্বকালের শেষ মাথায় অবস্থান করে ধ্বংস, বিলুপ্তি। একটি জাতিসত্তার বিলুপ্তি। চলবে