স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৮

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২৩

শুটিং শেষ। সেই খুশিতে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া গাইলেন ‘সাদা সাদা কালা কালা গান’―এটা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কোন অভিনেত্রী বা অভিনেতা প্রেম পড়লেন, বা কবে প্রেমে পড়বেন, বা আদৌ পড়বেন কিনা―এসব নিয়েও গণমাধ্যমে নিউজ হতে দেখি। এমনকি এক অভিনেত্রী শুটিংয়ের সময় পশ্চাদৎদেশে বায়ু নিঃসরণ করেছেন, এটাকেও নিউজ হতে দেখেছি।

 

কিংবা সাম্প্রতিক কালের এক ভাঁড়ের কথাও বলা যায়। তিনি কোথায় ভাঁড়ামি করলেন, কোন নিম্নমানের হোটেলে গিয়ে ভাঙা প্লেটে ভাত খেলেন, কখন হেঁড়ে গলায় গান গাওয়ার নামে ভাঁড়ামি করলেন, সেগুলোও নিউজ হয়ে থাকে। কিংবা এক পাতি-ধর্মবেত্তা, যার কাজ ধর্মীয় গোঁড়ামির উসকানি দেওয়া, তিনি জ্বরাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, সেটাও নিউজ হয়েছে। সেদিন দেখলাম, এক অভিনেত্রী স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে ডাক্তারের কাছে গেছেন, এটাও নিউজ হয়েছে।

 

অপরদিকে, ধরুন বদরুদ্দীন ওমর বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জ্বরাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এটা কি গণমাধ্যমে নিউজ হবে? কিংবা নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রামেন্দু মজুমদার বা কবি নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, কামাল চৌধুরী বা অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে ডাক্তারের কাছে গেছেন―এটা কি নিউজ হবে? কিংবা কোনো তরুণ কবি প্রেমে পড়েছেন বা বিয়ে করেছেন বা সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন―এসব কি নিউজ হবে? না, হবে না। কারণ, নুসরাত ফারিয়া বা মৌসুমী বা পরীমণি বা শাকিব খানের মতো অত সস্তা জনপ্রিয় নন তারা। সে কারণে গণমাধ্যমে তাদের এসব খবর ভ্যালুহীন। এসব তুচ্ছ বিষয়ে সংবাদ শিরোনাম হবেন―এটা অবশ্য তারা চানও না।

 

কিন্তু সিনিয়র কোন লেখক এবার কী বই লিখছেন, কোন তরুণ কবির এ বছর কোন বইটি প্রকাশিত হবে, এ সপ্তাহে কোন ভালো একটি বইটি প্রকাশিত হলো, কোন লেখক অর্থকষ্টে ভুগছেন, চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন, বই প্রকাশে প্রকাশক খুঁজে পাচ্ছেন না―এসব খবর কি গণমাধ্যমে দেখা যায়? না, দেখা যায় না। আচ্ছা, মেনে নিলাম। মেনে নিলাম যে, এসব খবরও গণমাধ্যমের কাছে ভ্যালুহীন। কিন্তু বদরুদ্দীন ওমর বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বা নির্মলেন্দু গুণ কিংবা অন্য কোনো শীর্ষ লেখক-কবি-সাহিত্যিক কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন―এটাও কি গণমাধ্যমের কাছে ভ্যালুহীন?

 

আমরা দেখছি যে, ঢাকা শহরে কোথাও যদি সাহিত্য-বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান হয়, সেখানে সংবাদ সংগ্রহের কাজে আসা কোনো সাংবাদিককে দেখা যায় না। সাহিত্য বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করে, অনুরোধ করে, বারবার ফোন করেও আনা যায় না। কেন আনা যায় না? কারণ একটাই: গণমাধ্যমের কাছে সাহিত্য বিষয়ক এসব অনুষ্ঠানের ভ্যালু নেই। এসব খবর মানুষ পড়বে না, দেখবে না, শুনবে না। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলা ট্রান্সলেশান ফাউন্ডেশনের সংবাদ সম্মেলন। কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন গতকাল ফেসবুকে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। সাহিত্যের প্রতি গণমাধ্যমের এই উদাসীনতার প্রসঙ্গটি আক্ষেপের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। তার কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

 

বুঝলাম, সাহিত্য বা সাহিত্যিকদের খবর গণমাধ্যমের কাছে ভ্যালু নেই। গণমাধ্যমের চাই টিআরপি, চাই ফেসবুক লাইক, চাই ভিউ, চাই কমেন্ট, চাই শেয়ার। নইলে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা যাবে না। কিন্তু গণমাধ্যমের কি কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই? প্রত্যেক ব্যক্তির সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের থাকে। এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে সিএসআর খাতে টাকা ব্যয় করে, কেন করে? কারণ ওটা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। একটি রাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে গণমাধ্যমের। কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজনদের কথা, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানের ভ্যালু তৈরি করার দায় গণমাধ্যমের। কেবল সংবাদ প্রচার নয়, সম্মতি উৎপাদনও গণমাধ্যমের কাজ। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ইতিবাচক, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু সমাজের জন্য ভালো, তার পক্ষে গণসম্মতি উৎপাদনের দায় গণমাধ্যমের রয়েছে।

 

গণমাধ্যম বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে গণসম্মতি উৎপাদন করতে আমরা দেখি, বিশেষ পণ্যের পক্ষে গণসম্মতি উৎপাদন করতে দেখি, বিশেষ মতবাদের পক্ষেও গণসম্মতি উৎপাদন করতে দেখি। সেদিন দেখলাম ফরিদপুরের কোনো এক মরমি সাধকের মাজারে নেচে নেচে ভক্তরা গান গাইছেন। সাধকের মাজারে নৃত্যসহযোগে গান গাওয়া বাংলার সাধনধারার এক বিশেষ পদ্ধতি। এক টেলিভিশন সেটা নিউজ করেছে। নিউজের শেষে রিপোর্টার বলছেন, ‘যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলাম ধর্মে গান-বাজনা হারাম।’ এই কথাটি যে রিপোর্টার তার রিপোর্টে লাগিয়ে দিলেন, এটা কি সাংবাদিকতার এথিক্সের মধ্যে পড়ে? পড়ে না। কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম নয়, কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম―এই ফতোয়া দেওয়ার কাজ গণমাধ্যমের নয়। কিন্তু সেই টিভি গানবাজনার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে গণসম্মতি উৎপাদন করেছে।

 

নাট্যকার মামনুর রশীদ যে বলেছিলেন, ‘আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে’―কথাটা মিথ্যে নয়। রুচির দুর্ভিক্ষ কেবল জনসাধারণের মধ্যে নয়, গণমাধ্যমেও দেখা দিয়েছে। পত্রিকাগুলো এখন সাহিত্যপাতাকে সংকুচিত করছে। দৈনিক ‘সমকালে’র জনপ্রিয় সাহিত্য মাগ্যাজিন ‘কালের খেয়া’ ম্যাগাজিন সাইজে বের হতো। নতুন সম্পাদক যোগ দিলেন। পত্রিকার খরচ কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য তিনি ‘কালের খেয়া’কে ব্রডশিটে নিয়ে এলেন। অন্যান্য পত্রিকাগুলোতেও সাহিত্যপাতা অনেকটা অবহেলিত। বের করতে হয় বলে করা। অধিকাংশ পত্রিকা লেখকদের কোনো সম্মানিটাও দেয় না। টেলিভিশনগুলোতে তো সাহিত্য-বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান নেই বললেই চলে। তারা সবসময় ব্যস্ত থাকে পপুলার আইটেম নিয়ে। সাহিত্যকে পপুলার করার কোনো দায় আছে বলে তারা মনে করে না।

 

অনেক দৈনিক, টেলিভিশন ও রেডিওতে কালচারাল বিট উপেক্ষিত। অনেক গণমাধ্যমে কালচারাল রিপোর্টার বলতে কেউ নেই। কেন থাকবে? কালচারাল বিটের খবর কে পড়ে? কেন খালি খালি এই বিটে রিপোর্টার রেখে টাকা নষ্ট করা? এসব গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাই আবার দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত। টকশোতে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁরা বড় বড় বুলি ছাড়েন। এই দেশে ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে না, ভালো গল্প লেখা হচ্ছে না, ভালো উপন্যাস লেখা হচ্ছে না, ভালো নাটক হচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেন। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই যে বইমেলার সময় সাংবাদিকরা নিষ্ঠার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করেন। কিন্তু বই কি কেবল এক মাসের জন্য? সারা বছর কি আর বইয়ের দরকার নেই?

 

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ভালো কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা নাটক লেখার সঙ্গে গণমাধ্যমের কী সম্পর্ক? না, প্রত্যক্ষভাবে কোনো সম্পর্ক নেই বটে। কোনো কবি-সাহিত্যিক গণমাধ্যমের ওপর ভরসা করে কবি-সাহিত্যিক হন না। কিন্তু কবিতা ও সাহিত্য যে রুচি তৈরির সহায়ক, বোধ তৈরির সহায়ক, প্রজ্ঞা তৈরির সহায়ক, সাহিত্য যে মানুষের জন্য কল্যাণকর―এই বার্তাটি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে। হতেও তো পারে পত্রিকায় কবিতা বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানের খবর দেখে, টেলিভিশনে উপন্যাস বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানে গুণী কোনো কথাসাহিত্যিকের বলা কথাগুলো শুনে প্রান্তবাংলার কোনো এক তরুণ কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ হবে, গল্প-উপন্যাস বা নাটক লেখায় উদ্বুদ্ধ হবে। কিংবা জীবনের সঠিক মার্গটি খুঁজে পাবে। এমনটা তো হয়, হয়ে থাকে।

 

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন। তারা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন নিঃসন্দেহে। তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে গণমাধ্যমের কোনো ভূমিকা আছে কিনা? সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি গণমাধ্যমের এই উদাসীনতা, এই উপেক্ষা ঠিক হচ্ছে কিনা? এর পরিণাম শুভ হবে না অশুভ হবে? আশা করছি, কোনো একজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিকের কাছ থেকে কিংবা একাধিকজনের কাছ থেকে এই প্রশ্নের গঠনমূলক একটি উত্তর পাব। চলবে

 

৬.১০.২০২৩