স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৯

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৭, ২০২৩

একদিন, স্মৃতিজাগানিয়া এমন ঘনঘোর শাওন রাতে এই পৃথিবীতে থাকব না। শুনব না রবীন্দ্রনাথে অমীয় বাণী ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে।’ খুব মন খারাপ হয় তখন। খানিক পর মন খারাপ আবার কেটেও যায়। মন ছেয়ে যাওয়া কালো মেঘ মুহূর্তে সরে যায়। ভাবি, রবীন্দ্রনাথ গেছেন, গ্যাটে গেছেন, দান্তে গেছেন, তলস্তয় গেছেন, মার্কেজও গেছেন। চলে গেছেন হাফিজ, খৈয়াম রুমি, ফেরদৌসি, জামি। চলে গেছেন বাল্মিকী, বেদব্যাস, কালিদাসসহ কত কত মহাজন। আমি কোথাকার কোন ছার যে, চিরকাল আলো-অন্ধকারের এই পৃথিবীতে থাকব?

সেদিন লেখক কামরুল আহসানের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল মৃত্যু প্রসঙ্গে। আমার কি মৃত্যুভয় নাই? আছে, অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে ভয় আছে। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে কোনো ভয় নেই। কেননা আমি বহু শাস্ত্র ঘেঁটে, এই মানবজীবনের তত্ত্বতালাশ করে এই জ্ঞান অর্জন করেছি যে, একটা সময় আসলে পৃথিবীতে মানুষের কোনো কাজ থাকে না। বয়স যখন আশি, নব্বই কিংবা একশো বছর হয়ে যায়, মানুষটি তখন অপাংক্তেয় হয়ে যায়। নিকটজনদের কাছেও বোঝা হয়ে যায়, সবার কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। সামনে সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করলেও, ভালোবাসার কথা বললেও মনে মনে বলে, লোকটি এখনো আছে কেন? চলে যাচ্ছে না কেন? আমরা কেউ স্বীকার করি বা না করি, এটাই বাস্তবতা। এই জীবনের নির্মম বাস্তবতা।

মৃত্যুচিন্তা এলে পুরাণের কাছে ফিরে যাই। রাম যখন লঙ্কা জয় করলেন, অশ্বমেধ যজ্ঞও সমাপ্ত করলেন, রাজ্যের সমস্ত কাজ সমাপ্ত করলেন, সীতাও যখন মাটি ফুঁড়ে অন্তর্হিত হলেন, তখন রামের কী কাজ? এই জীবন নিয়ে তিনি কী করবেন? তখন তিনি এই পৃথিবীতে থাকার মতো কোনো প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পেলেন না। ভ্রাতাদের নিয়ে চলে গেলেন জলসমাধিতে। কিন্তু হনুমান? তিনি তো চীরঞ্জীবি। মৃত্যুহীন। আরাধ্য রামহীন এই পৃথিবীতে তার কী কাজ? দেবতারা তাকে বললেন, তুমি ওই পাহাড়ে যাও। সেখানে বানররাজ রূপে রূপে বিরাজ করো। কিন্তু হনুমানের রাজ্য দিয়ে কী হবে? তিনি তো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ শেষ করে ফেলেছেন। বড় বড় যুদ্ধগুলো জয় করে ফেলেছেন। এই জীবন দিয়ে তিনি এখন কী করবেন? তিনি পাহাড় চূড়ায় বসে বসে জপ করতে লাগলেন, ‘রাম! রাম!’ তখন আমাদের মনে তৈরি হয় এক গভীর হাহাকার। মনে হয়, হনুমানের মতো একদিন এই পৃথিবীতে আমারও কোনো কাজ থাকবে না। চলে যাওয়াটাই হবে তখন একমাত্র সামাধান।

কুরুক্ষেত্র মহামহিম ভীষ্মের প্রতাপে কাঁপছে। লাখে লাখে সৈন্য মরছে। রথচক্র হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন কৃষ্ণ। বললেন, ‘হে গঙ্গপুত্র, তুমি হস্তিনাপুরকে রক্ষার পণ করেছ। অথচ তুমি সিংহাসনকেই ভেবে বসে আছ হস্তিনাপুর। হস্তিনাপুর তো কেবল সিংহাসন নয়, হস্তিনাপুর অনেক বড়। তোমার জন্যই এত যুদ্ধ, তোমার জন্যই এত রক্তপাত। তোমাকে মরতে হবে। তোমার মৃত্যুই এই যুদ্ধের একমাত্র সমাধান।’

কৃষ্ণকে দেখুন। যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল গান্ধারির অভিশাপে। গান্ধারির অভিশাপে, নাকি পূর্বনির্ধারিত নিয়তিতে? মহাভারত বলে গান্ধারীর অভিশাপের কথা। কিন্তু তৎপূর্ব পুরাণ বলে পূর্বনিধারিত নিয়তির কথা। যে কারণেই হোক, যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল, দ্বারকা নগরী তলিয়ে গেল গভীর সমুদ্রের। শ্রীকৃষ্ণের কোনো কাজ নেই। এই পৃথিবীতে তিনি আর কোনো কাজ খুঁজে পান না। অরণ্যের বৃক্ষতলায় তিনি শায়িত হলেন। বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বুঝি ভাবছিলেন, ‘দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা/ তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহাতি।’ আর তখন ব্যাধের তীর এসে বিদ্ধ করল তার পদতল।

ওদিকে অ্যাকিলিস। কত সৈন্য মরে, কত রথি মরে, কত মহারথি মরে, অথচ মরে না অ্যাকিলিস। তিনি বধহীন। তাকে বধ করার সাধ্য নেই কারো। জলদেবী যতই তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করুন না কেন, তার পুত্র তো মানুষ। সেই মানুষের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অ্যাকিলিসের মৃতুকে সম্ভব করে তোলার জন্য হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় দেবতাদের। প্যরিসকে তারা মন্ত্রণা দেন। শিখিয়ে দেন কী করে মারতে হবে বীর অ্যাকিলিসকে। অবশেষে প্যারিসের নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত তীর স্পর্শ করে অ্যাকিলিসের গোড়ালি। মৃত্যু হয় যুদ্ধের মাঠ কাঁপানো এই বীরের।

মানুষকে তাই চলে যেতে হয়। বৃক্ষে নতুন পাতার জন্মের জন্য পুরনো পাতাকে মরে যেতে হয়, ঝরে যেতে হয়। বসন্তকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য শীতকে চলে যেতে হয়। নদীর এই পারে চর জাগিয়ে দেওয়ার জন্য ওই পারকে নদীগর্ভে চলে যেতে হয়। কলার জন্ম দিয়ে কলাগাছকে মরে যেতে হয়। সন্তানের জন্ম দিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে সমস্ত প্রাণীকে চলে যেতে হয়। তেমনি জীবনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমাপ্ত করে মানুষকেও চলে যেতে হয়। চলে যাওয়াটাই সৌন্দর্য। চলে যাওয়াটাই নিয়ম। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। ব্যত্যয় ঘটলে সৃষ্টিতে তৈরি হবে অসন্তুলান।

কিন্তু ভয় রোগ-শোক-জরাকে নিয়ে। বিছানায় মুমূর্ষ দশায় পড়ে থেকে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষার চেয়ে নির্মম আর কী হতে পারে! কিন্তু মানবজীবনে রোগ-শোক-জরা অবশ্যম্ভাবী। পাণ্ডবরা যখন মহাপস্থানের পথে নির্গত হলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ধর্মরাজ, এত কষ্ট করে পায়ে হেঁটে স্বর্গে যাওয়ার কী দরকার। আমার রথে ওঠো। আমি তোমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেব স্বর্গে। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘অর্জুন আপনার পুত্র। এই ব্যাপারে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন।’ অর্জুন বললেন, ‘হে পিতা, আপনি পূর্ণ দেবতা, আমি দেবতার অংশ মাত্র। আমি মানুষ। তাই আমাকে রোগ-শোক-জরার কষ্ট সয়ে, কষ্ট অতিক্রম করে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।’ ইন্দ্র বললেন, ‘যথার্থ বলেছ পুত্র। আমি তোমার জন্য গর্বিত।’

মৃত্যু যে সুন্দর, এই সত্য বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বলেছেন :
মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান!
মেঘ বরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট
রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট
তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু অমৃত করে দান!
তুঁহু মম শ্যাম সমান।

মৃত্য ছিল, আছে, থাকবে। তাই বলে মৃত্যুভয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যেতে হবে? অবশ্যই না। উপভোগ করতে হবে এই জীবন। উপভোগ করতে হবে এই রূপবান পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্য। অবিশ্রান্ত চালিয়ে যেতে হবে এই আনন্দযজ্ঞ। যজ্ঞ যজ্ঞ করতে করতে রবীন্দ্রনাথের মতো নিজেকে বারবার বলতে হবে, ‘ধন্য হলো ধন্য হলো মানবজীবন।’ চলবে

৬ অক্টোবর, রাত ১১.৩০