স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৯০

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৫, ২০২৩

অমিয়ভূষণ মজুমদারের কাছ থেকে একটা চমৎকার বিষয় শেখা গেল―এসকেপিজম। যার বাংলা অর্থ পলায়নপরতা। কীসে থেকে পলায়ন? বাস্তবতা থেকে পলায়ন, পারিপার্শ্বিকতা থেকে পলায়ন। মদ খেলে বা গাঁজা খেলে যেমনটা হয়। নেশাতুর ব্যক্তিটি তার পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যায়। নেশার প্রভাবে নিজের ভেতর তৈরি হয়ে যায় এক স্বতন্ত্র জগৎ। একবার আমি গাঁজা খেয়েছিলাম নিঝুম দ্বীপে গিয়ে। নিজেকে তখন পূর্ণিমার ভরাট চাঁদে দেখতে পেয়েছিলাম। দেখছিলাম, আমি সম্রাট শাহজানরূপে, শাহজাহানেরই মতো রাজকীয় আসকান পরে সুসজ্জিত সিংহাসনে বসে আছি। অর্থাৎ সেই নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আমি চলমান বাস্তবতা থেকে এসকেপ নিয়েছিলাম। গাঁজা আমাকে এসকেপ নিতে সাহায্য করেছিল।

শিল্পসৃষ্টির সময় প্রত্যেক শিল্পীর এসকেপের প্রয়োজন হয়। নইলে তিনি শিল্পকর্মটি করে উঠতে পারেন না। লেখক যখন লেখার টেবিলে, তিনি যখন লিখছেন, অর্থাৎ শিল্পসৃষ্টি করছেন, তখন তাকে এসকেপ করতে হয়, বিচ্ছিন্ন হতে হয়। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, সংসার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি গৃহে আছেন, আসলে কিন্তু নেই। তিনি সংসারে আছেন, আসলে কিন্তু নেই। তিনি সমাজে আছেন, আসলে কিন্তু নেই। তিনি স্ত্রীর কথা শুনছেন, আসলে তিনি শুনছেন না। তার শরীর চলমান বাস্তবে থাকলেও মন অন্যত্র, কান অন্যত্র, ধ্যান অন্যত্র―তারই কল্পিত বাস্তবতায়। সেখানেও মানুষ আছে, নর-নারী আছে, প্রেম-অপ্রেম আছে, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ-রক্তপাত আছে, পশুপাখি আছে, তরুলতা আছে, নদী-সমুদ্র আছে, পাহাড়-ঝরনা আছে।

এসকেপ কেবল লেখকই নেয়? না, পাঠকও নেয়, দর্শকও নেয়, শ্রোতাও নেই। আপনি যখন পিকাসোর চিত্রকর্ম দেখছেন, তখন চিত্রকর্মটিই দেখছেন, প্রেমিকার কথা ভাবছেন না, বাজারে গিয়ে মাছ-মাংস-শাক-সবজি কেনার কথা ভাবছেন না, সমুদ্র-ভ্রমণের কথা ভাবছেন না। অর্থাৎ আপনি এসকেপ নিয়েছেন। আপনি যখন গদারের সিনেমা দেখছেন, তখন সিনেমাটিই দেখছেন। গদারের নির্মিত জগতে প্রবেশ করেছেন। রাস্তায় যানজটের কথা ভাবছেন না, বসুন্ধরা মার্কেটের কোন দোকানে কোন ব্রান্ডের শার্ট এলো, তা নিয়ে ভাবছেন না। আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনছেন, তখন গানটিই শুনছেন, রবীন্দ্র ভাবরসে সিক্ত হচ্ছেন। তখন জমির দলিলের কথা ভাবছেন না, কার সঙ্গে গতকাল ঝগড়া হয়েছিল, তা নিয়ে ভাবছেন না।

একইভাবে একজন পাঠক যখন কোনো কবিতা পড়ে, গল্প পড়ে কিংবা উপন্যাস পড়ে, তখন তাকেও এসকেপ নিতে হয়। লেখকের সঙ্গে একাত্ম হতে হয়। লেখক কোন বাক্যে কোন শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কেন ব্যবহার করেছেন, শব্দটি কী অর্থ বহন করছে, কী আবহ তৈরি করছে, কিংবা লেখক যে অ্যলিউশনের ব্যবহার করেছেন, যে চিত্রকল্প ব্যবহার করছেন, যে মেলোড্রামা তৈরি করছেন, তার মধ্য দিয়ে আসলে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন, তা বোঝার জন্য এসকেপ নিতেই হবে। অর্থাৎ কেবল লেখক নয়, সাহিত্যের রস আস্বাদনের জন্য পাঠককেও এসকেপ নিতে হয়। নিজেকে বাস্তবতা থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হয়। নইলে শিল্প উপভোগ সম্ভব হয় না। সংস্কৃতি সাহিত্য একেই বলছে ‘সহৃদয় হৃদয় সংবাদী।’ অর্থাৎ কাব্যরসাস্বাদী সহৃদয় ব্যক্তির হৃদয়েই কেবল রসের অবস্থান সম্ভবপর।

যে সাহিত্য এসকেপ করছে না, বাস্তব জগৎ থেকে পাঠককে বিচ্ছিন্ন করছে না, কিংবা যে সাহিত্য পাঠের সময় পাঠক সহজেই সবকিছু বুঝে যাচ্ছে, লেখক সমস্ত কিছু আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আপনাকে কিছুই ভাবতে হচ্ছে না, কোনো কষ্টই করতে হচ্ছে না, নিশ্চিতভাবে তা দুর্বল সাহিত্য। হোক তা কবিতা, গল্প বা উপন্যাস। চলবে

১৫.১০.২০২৩