হাসান আজিজুল হক ও স্বকৃত নোমান

হাসান আজিজুল হক ও স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘শিল্পপিতার বিদায়’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২১

কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক স্যারকে একবার হুমকি দিয়েছিল শিবির ক্যাডারেরা। হুমকির সেই ঘটনাটি ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট। তাঁকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। বলেছিল, তাঁর পরিণতি হবে হুমায়ুন আজাদের মতো। আগের দিন, অর্থাৎ ২৩ আগস্ট অধ্যাপক জাফর ইকবালকে শিবির ক্যাডারেরা জিব কেটে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ১ সেপ্টেম্বর আমি দৈনিক সমকালের মুক্তমঞ্চ পাতায় ‘সাম্প্রদায়িকতার টার্গেট হাসান-জাফর’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম।

তখনো হাসান স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। পরের বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীন স্যারের বাসায় তাঁর সঙ্গে দেখা। সমকালের সেই লেখাটি আমার সংগ্রহে ছিল। স্যার আসবেন জেনে লেখাটি বাসা থেকে সেলিম স্যারের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। হাসান স্যারকে দেখালাম লেখাটি। পড়ে বললেন, ‘ভালোই তো লিখেছ। বেশ বেশ।’

সেই শুরু তাঁর সঙ্গে। মাঝের কয়েক বছর আর যোগাযোগ নেই। তারপর একদিন একুশে বইমেলায় দেখা। ‘খ্যাতিমানদের শৈশব’ নামে একটি বই লিখেছি। বইটিতে তাঁর শৈশব নিয়েও একটা লেখা আছে। তাঁকে দিলাম বইটি। তাঁর শৈশব নিয়ে লেখাটি পড়ে বললেন, ‘একটা রসগোল্লা খেতে দিলে, বেশ ভালো লাগল।’ বলেই হো হো করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘জীবনানন্দ পড়েছ?’ বললাম, ‘জি স্যার, পড়েছি।’ বললেন, ‘আবার পড়ো।’ বলেই তিনি পাঠ করতে লাগলেন জীবনানন্দের পঙক্তি:

আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—
শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে;
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস;...

আমি যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, জীবনানন্দের কিছুই পড়িনি, আবার পড়তে হবে। সেদিনই জীবনানন্দের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কিনে নিয়ে গেলাম আজিজ মার্কেট থেকে। আবার শুরু করলাম জীবনানন্দ পাঠ।

হাসান স্যার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের অধ্যাপক। গোলাম মোর্তোজা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য হাসান স্যারের একটি সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আচ্ছা তুমি মার্কেজ পড়েছ?’ বললাম, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস্ অব সলিসিউড পড়ার চেষ্টা করেছিলাম, শেষ করতে পারিনি।’ তিনি বললেন, ‘মার্কেজ পড়োনি, এ কেমন কথা!’ তুমি না উপন্যাস লেখ? পৃথিবীর কোন ঔপন্যাসিক কী লিখেছেন, তা তুমি জানবে না? লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা, আহা, আমার প্রিয় উপন্যাস, বুঝলে? শেষটায় দেখবে, লেখার কী শক্তি মার্কেজের! লিখেছেন, কাপ্তান ফারমিনা ডাজার দিকে তাকাল, সে ওর চোখের পাতায় লক্ষ করল শীতের তুষারের প্রথম ঝিলিক। তারপর সে তাকাল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দিকে, তার অপরাজেয় শক্তির দিকে, তার নিঃশঙ্ক প্রেমের দিকে এবং বিলম্বে-উপলব্ধ একটি সন্দেহ দ্বারা সে অভিভূত হলো, মৃত্যুর চাইতে বেশি জীবনের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। কী অসাধারণ, তাই না?’

সেদিনও আমি মুগ্ধ ও বিষ্ময়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, কবিতার মতো উপন্যাসও তিনি কী অবলীলায় মুখস্থ বলতে পারছেন! আমি তো কিছুই পারি না। এখনো মার্কেজ পড়িনি। আজই শুরু করতে হবে। সেদিন শুরু করলাম হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিসিউড পড়া। তারপর পড়লাম ‘লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা’। তারপর একে একে মার্কেজের সব কটি উপন্যাস ও গল্প পড়ি। মার্কেজ পড়ার এই অনুপ্রেরণা আমি হাসান স্যারের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি কৃতজ্ঞ তাঁর প্রতি। তিনি আমাকে একটি মহাসিন্ধুর সন্ধান দিয়েছেন।

দিনে দিনে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠতে থাকে। মাঝেমধ্যেই তিনি ঢাকায় আসতেন। ঢাকায় আসার আগেই ফোন করতেন। কোনদিন আসবেন জানিয়ে দিতেন। আমাকে অবশ্যই সঙ্গ দিতে হবে তাঁকে। কোনো কারণে সঙ্গ দিতে না পারলে তিনি মন খারাপ করতেন, বারবার ফোন করতেন। জানতে চাইতেন কখন ফ্রি হবো, কখন আসতে পারব। বহুদিন তাঁর সঙ্গে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। বহুদিন তাঁর সঙ্গে বহু জায়গায় গিয়েছি। বহুদিন তাঁকে প্লেনে তুলে দিতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গিয়েছি। রাজশাহীর ‘বিহাস’-এ তার বাড়ি ‘উজান’-এ বহুবার আড্ডা দিয়েছি।

দুদিন পরপরই তিনি তাঁর বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে ফোন করতেন। কথা চলতে থাকত। কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দু-আড়ই ঘণ্টা। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি—নানা বিষয়ে কথা হতো। আমাদের সময়ের লেখকদের কে কী লিখছেন, কার কী বই প্রকাশিত হলো—সব খোঁজখবর নিতেন। কার লেখা ভালো লেগেছে তাঁর, কার লেখা খারাপ লেগেছে, সব বলতেন। আলাপ চলত বিশ্বসাহিত্য নিয়েও। মার্কেজ, ফকনার, হেমিংওয়ে, জোলা, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, সারামাগো, বোর্হেস, ইয়োসা প্রমুখের গল্প-উপন্যাস নিয়ে বলতেন, শুনতেন আমার কাছ থেকেও। তাঁর পাঠের সঙ্গে আমি মিলিয়ে নিতাম আমার পাঠ।

মাঝেমধ্যে অনুলিখন করতাম স্যারের লেখা। তিনি ফোনে বলতেন, আমি রেকর্ড করে নিতাম। কিংবা তিনি বলে যেতেন, আমি লিখে যেতাম। সেসব লেখা ছাপা হতো নানা পত্রিকায়। এভাবে কুড়িটিরও বেশি লেখা অনুলিখন করেছি। একদিন হাসতে হাসতে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না এবং যোগাযোগ রাখব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি উদ্বেগের স্বরে বললেন, ‘কেন কেন? আমি কী করেছি?’ আমি বললাম, ‘বড় অন্যায় করেছেন। আপনি আমার একটা বইও পড়েননি। কোনো উপন্যাস পড়ে একটা কথাও আমাকে বলেননি।’ তিনি হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তোমার বেশ কিছু গল্প তো পড়েছি। হ্যাঁ, উপন্যাস পড়িনি এটা বলতে পারো। তবে শিঘ্রই পড়ব।’

আমার ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর প্রথম কপিটি নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। তিনি তখন ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। বইটি তিনি উল্টেপাল্টে দেখলেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। বেশ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বললেন, ‘হচ্ছে, তোমার লেখা হচ্ছে।’ ব্যস, এটুকুই। উপন্যাসটি তিনি নিয়ে গেলেন রাজশাহী। কয়েক মাস পর ফোন করে জানালেন উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছেন। অনেকক্ষণ ধরে পাঠপ্রতিক্রিয়াও জানালেন।

তারপর থেকে তিনি আমার বইগুলো পড়তেন। প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে পাঠিয়ে দিতাম এক কপি। কোনো পত্রিকায় লেখা ছাপা হলে পড়ে তিনি ফোন দিতেন। পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতেন। একবার ‘কালি ও কলমে’ ছাপা হলো ‘জীবন’ নামে একটি গল্প। গল্পটি পড়ে তিনি আমাকে ফোন করলেন। যথেষ্ট তিরস্কার করলেন। বললেন, ‘রস নেই, গন্ধ নেই, একেবারে খটখটে শুকনো একটা গল্প। এসব কেন লেখ? লিখতে হবে কেউ তোমাকে দিব্যি দিয়েছে? হবে না, স্বকৃত। এভাবে হবে না। এমন গল্প লিখে সময়ের অপচয় করে ফেলছ।’ আরো অনেক কথা বললেন, অনেক তিরস্কার করলেন। আমি শুধু শুনে গেলাম। শুধু বলে গেলাম, ‘আর লিখব না স্যার, কখনোই লিখব না। গল্পটি আসলেই দুর্বল।’ তিনি বললেন, ‘দুর্বল গল্প ছাপতে দাও কেন?’

শেষদিকে তাঁর স্মৃতিভ্রম হতো খুব। আমি তখনো বুঝতে পারিনি তাঁর যে স্মৃতি ঝামেলা করছে। একদিন তিনি ফোন করে বললেন, ‘আচ্ছা স্বকৃত, তুমি সাবিত্রী উপাখ্যান পড়েছ?’ আমি বললাম, ‘এ কেমন কথা স্যার! আপনার সাথে উপন্যাসটি নিয়ে কতবার কথা হয়েছে, প্রকাশের আগেও তো কতবার কথা হয়েছে, সব ভুলে গেলেন!’ তিনি বললেন, ‘ও আচ্ছা, পড়েছ না?’

সেদিন প্রথমবারের মতো বুঝতে পারি তাঁর স্মৃতিভ্রম ঘটছে। পরবর্তকালেও বহুবার টের পেয়েছি। এমনও হয়েছে, সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হলো, রাতে তিনি ফোন করে বললেন, ‘তোমাকে পাচ্ছি না অনেক দিন, ব্যস্ত নাকি?’ আমি বলি, ‘স্যার, সকালে আপনার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, আপনি ভুলে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘ওহ্, কথা হয়েছে? ভুলে গিয়েছিলাম, বুঝলে, ভুলে গিয়েছিলাম।’

হাসান আজিজুল হক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমি সরাসরি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই। কিন্তু ছাত্রেরও অধিক। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি সাহিত্যের অনেক কিছু। তিনি আমাকে অকুণ্ঠচিত্তে শেখাতেন। তাঁকে আমি বলতাম ‘শিল্পপিতা।’ বলতাম, ‘স্যার, আপনি তো আমার শিল্পপিতা।’ স্যার হেসে বলতেন, কীসব যে বলো! শিল্পপিতা শব্দটি সুন্দর। কিন্তু এই পিতা হওয়ার যোগ্যতা তো আমার নেই গো, স্বকৃত।’ আমি বলতাম, ‘আপনার যোগ্যতা না থাকলে কার আছে, তার নাম বলেন। এখন থেকে তাকে শিল্পপিতা ডাকব।’ স্যার তখন হো হো করে হেসে উঠতেন।

আমি কোনো বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিলে তিনি নির্দ্বিধায় আমাকে সমর্থন করতেন। যেমন বেশ কয়েকবার বন্যার্তদের নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছি। তিনি কোনো প্রশ্ন ছাড়া উপদেষ্টা হিসেবে থেকেছেন। কখনো কোনো ঘটনার প্রতিবাদের দরকার হলে প্রতিবাদপত্রে তাঁর নামটি যুক্ত করার জন্য তাঁকে ফোন করলে তিনি বলতেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করার কী দরকার? তোমার যেখানে ইচ্ছা আমার নামটি বসিয়ে দাও।’ এমন অভিভাবক আমি আর কোথায় পাব? কে দেবে আমাকে এমন স্নেহ?

আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো হাসান আজিজুল হক কখনোই মরবেন না। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে এমনই দেখে যাব। কেন এমনটা মনে হতো জানি না। হয়ত আমি তাঁকে বেশি শ্রদ্ধা করতাম বলে। হয়ত তাঁকে বেশি ভালোবাসতাম বলে। কিন্তু মৃত্যু তো অমোঘ। সেই অমোঘকে আজ বরণ করে নিলেন হাসান আজিজুল হক। চলে গেলেন আমার শিল্পপিতা। আমি কেমন করে তাঁকে বিদায় জানাই! আমি কেমন করে বলি হাসান স্যার মারা গেছেন! আমি কেমন করে বলি হাসান স্যারকে আর কখনো দেখব না!

না স্যার, আপনাকে বিদায় বলব না। অসম্ভব। আপনি আমার কাছে থাকবেন। আমার হৃদয়ে থাকবেন। আমার স্মৃতিতে থাকবেন। আমি জানি, আপনার একটি হাত চিরকাল আমার মাথার ওপর থাকবে। সেই হাত সরবে সেদিন, যেদিন আপনার মতো আমিও অমোঘ সত্য মৃত্যুর হাত ধরে চলে যাব।

১৫.১১.২০২১