স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘সাম্প্রদায়িকতা আমাদের গভীর গভীরতর অসুখ’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৫, ২০২৪

কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের লেখক। কিন্তু তাঁর সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম দুই সমাজকেই পাওয়া যায়। কেন? কারণ তিনি দুই সমাজ ও সংস্কৃতিকে গভীর থেকে দেখেছেন, ভালো বুঝতেন। সে-কারণেই তাঁর গল্প-উপন্যাসে হিন্দু সমাজ ও জীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মুসলমান সমাজ ও জীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয়ও পাওয়া যায়। অপরদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশের লেখক। তাঁর গল্প-উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র মুসলমান। কেন? কারণ তিনি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতিকে গভীর থেকে দেখেছেন, বুঝেছেন। আর দেবেশ রায় পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী। তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিশাল অংশজুড়ে হিন্দু সমাজ, অধিকাংশ চরিত্র হিন্দু। কারণ তিনি হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিকে জন্ম থেকে দেখেছেন, গভীরভাবে বুঝেছেন।

এখন আমরা, এই উত্তরকালের পাঠকেরা, যদি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে এই অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, কেন তিনি ভারতের ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখলেন না? কেন তিনি পারসিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে লিখলেন না? কেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে ভারতের অন্য জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের মানুষের কথা সমানভাবে এলো না? কিংবা যদি দেবেশ রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলি, কেন তিনি মুসলমান সমাজ নিয়ে আরেকটা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ লিখলেন না? কেন তিনি শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হককে নিয়ে উপন্যাস না লিখে যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে লিখলেন? এসব অভিযোগ কতটা যৌক্তিক? সাহিত্যবোদ্ধারা একবাক্যে বলবেন, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

সাহিত্যের রীতিই হচ্ছে এই যে, সাহিত্যিক তার সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করেই লিখবেন। তলস্তয় রাশিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। দস্তয়ভস্কিও তাই লিখেছেন। কিন্তু তাঁরা পৃথিবীখ্যাত। পৃথিবীর দেশে দেশে পঠিত হচ্ছে তাঁদের সাহিত্য। জাপানের মানুষেরা যেমন তাঁদের সাহিত্য পড়ছে, তেমনি আমেরিকার মানুষেরাও পড়ছে। জাপানের পাঠকরা অভিযোগ করতে পারেন না, তলস্তয়-দস্তয়ভস্কি পৃথিবীখ্যাত কথাশিল্পী, অথচ তাঁরা জাপানিদের নিয়ে একটা শব্দও লিখলেন না!

গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর দেশের পটভূমিতেই গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, লাতিন জনগোষ্ঠীকে নিয়েই তাঁর সাহিত্যের কারবার। ব্যাস তাঁর ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীকে নিয়েই লিখেছেন। কালীদাস তাঁর জনগোষ্ঠীকে নিয়েই লিখেছেন। ভাসও তাঁর সমাজ-সংস্কৃতি নিয়েই লিখেছেন। ফেরদৌসী তাঁর দেশ, তাঁর সমাজ, তাঁর দেশের ইতিহাস, তাঁর দেশের সংস্কৃতি, তাঁর দেশের জনগোষ্ঠী নিয়েই লিখেছেন। দান্তে তাঁর দেশ, তাঁর জনগোষ্ঠী, তাঁর ধর্ম নিয়েই লিখেছেন। হোমার তাঁর দেশ, তাঁর দেশের ইতিহাস, তাঁর দেশের ধর্ম, তাঁর দেশের সংস্কৃতি, তাঁর দেশের জনগোষ্ঠীকে নিয়েই লিখেছেন।

কেউ যদি অভিযোগ তোলেন, ফেরদৌসী এত বড় কবি, ‘শাহনামা’র ভুবনখ্যাতি, অথচ তিনি চীনাদের নিয়ে একটা শব্দও লিখলেন না! কেন? অস্টেলিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে তাঁর কোনো লেখা নেই কেন? মার্কেজ এত বড় কথাশিল্পী, বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের ঘরে ঘরে তাঁর গল্প-উপন্যাস, অথচ তিনি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু লিখলেন না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে কিছু লিখলেন না। শহিদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখায় এলো না। শাহবাগ নিয়ে তিনি কোনো কথা বললেন না। কেন? ওরহান পামুক এত বড় ঔপন্যাসিক, তার ‘মাই নেম ইজ রেড’, ‘স্নো’, ‘ইস্তাম্বুল’ প্রভৃতি বই পড়ছে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক এবং সাধারণ পাঠকেরা, অথচ তিনি কক্সবাজারের এত বড়, এত সুন্দর সুমদ্র সৈকত নিয়ে একটা লাইনও লিখলেন না। কেন?

একইভাবে যারা বলেন, রবীন্দ্রনাথ এত বড় কবি, হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁর লেখা পড়ে, অথচ তিনি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটা শব্দও লিখলেন না। (যদিও তিনি লিখেছেন বিস্তর। কোথায় লিখেছেন, তা খুঁজে বের করার দায় যারা প্রশ্ন তোলে তাদের। এই লেখক কখনো এসব ফালতু প্রশ্ন তোলে না। তাই তার দায় নেই।) অথচ নজরুল হিন্দু-মুসলমান দুই জনগোষ্ঠীকে নিয়েই লিখেছেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ দোষী। তাঁকে মরণোত্তর ফাঁসি দিয়ে দাও।

যারা এসব বলে, তারা আসলে সাহিত্য-সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সাহিত্য-সমুদ্রকে দেখছে। সমুদ্রে কখনো অবগাহন করেনি। একবার অবগাহন করলে বুঝতে পারত এই সমুদ্র কেমন, এর জল কেমন, এর ঢেউ কেমন, এই সমুদ্র কত গভীর। তারা বুঝত, নজরুল তাঁর ধারায় লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধারায় লিখেছেন। বিভূতি-মানিক-তারাশংকর তাঁদের নিজ নিজ ধারায় লিখেছেন, শক্তি-শঙ্খ তাঁদের নিজ নিজ ধারায় লিখেছেন। প্রত্যেকের পথ আলাদা, কিন্তু গন্তব্য এক। আলোচনা হবে কী লিখেছেন তা নিয়ে, কী লেখেননি তা নিয়ে নয়।

প্রত্যেক লেখক স্বাধীন। বাংলাদেশের কোনো লেখক দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখতে পারেন। এটা তার খুশি। আবার মুসলমান কোনো কথাসাহিত্যিক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস নাই-বা লিখতে পারেন। এটা তার খুশি। কোনো হিন্দুধর্মাবলম্বী কবি তার কবিতায় মুসলমানদের নিয়ে না-ও লিখতে পারেন। এটা তার খুশি। কোনো বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কবি ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কবিতা না-ও লিখেতে পারেন। এটা তার খুশি। না লেখার জন্য তাকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না, কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি না। সাহিত্যিক কী লিখবেন, আর কী লিখবেন না—এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তিনি নবি নন। তাঁর কাঁধে গোটা দুনিয়ার ভার নেই। নবিগণও তাঁদের জাতিগোষ্ঠীর বাইরে পৃথিবীর হাজার হাজার জাতিগোষ্ঠী নিয়ে ভাবেননি, কথা বলেননি। বললে বাইবেলে আমরা অনার্য জনগোষ্ঠীর কথা পেতাম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের কথা পেতাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাসিয়া, ম্রো, বম বা চাকমাদের কথাও পেতাম।

সাম্প্রদায়িকতা আমাদের গভীর গভীরতর অসুখ। এই রোগ উপশমের কোনো টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। আমরা সেই বিজ্ঞানীর প্রতীক্ষায়, যিনি এই টিকা আবিষ্কার করে আমাদের এই দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি দেবেন।