হায় রেডিও নাটক, ফিরে আর আসবে কি কখনো

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২১

রেডিও নাটক শোনার অদম্য নেশা ছিল বাল্যবেলায়, সেই ৯০ দশকের শুরুতে। প্রতি শুক্রবার বিকেল ৩-৫ মিনিটে, আর বুধবার রাত ১০টায় নাটক শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম, আমাদের ছোট্ট রেডিওটিতে। শুক্রবার জুমার নামাজ ও খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রধান কাজই ছিল নাটকের অপেক্ষা। দৃশ্যমাধ্যমের এই প্রাবল্যের যুগে রেডিও নাটকের কথা মানুষ ভুলেই গেল বোধহয়! কী অনবদ্য সব নাটক! শিরিন বকুল ছিলেন রেডিও নাটকের সবচেয়ে খ্যাতিমান কণ্ঠ। আফরোজা বেগম ও শিলা আজিজসহ আরো অনেক কণ্ঠ তখন ছিল মুখস্ত।

সন্ধ্যা ৭ কিম্বা ৭-৩০টার দিকে হতো শার্লোক হোমসের ধারাবাহিক পর্ব। বার মনে নেই। কী যে উত্তেজিত প্রতীক্ষা ছিল গোয়েন্দা গল্পের অসামান্য এই শ্রুতিরূপের জন্যে! আজিজুল হাকিম আর শিরিন বকুলের কণ্ঠায়নে তুমুল সাড়া ফেলেছিল পরীর গল্প বা কী যেন একটা ধারাবাহিক। নানা উপলক্ষে ক্ষুদ্র নাটিকা প্রচারের রেওয়াজ ছিল, বিশেষত স্বাস্থ্য বা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন বিষয়ে। আসকার ইবনে শাইখ, উবায়দুল হক সরকার আর কার কার যেন মুসলিম ইতিহাসের ওপর নাটক প্রচারিত হতো।

দৃশ্যমাধ্যমের প্রচণ্ডতার এই যুগে রেডিও নামক এই শ্রুতিমাধ্যম প্রায় হারাতে বসেছে। এফএম রেডিওর চকিতে আগমন কেমন যেন চকিতেই মিলিয়ে গেল! রেডিওর যুগ এখনকার যুগের চেয়ে আরেকটু স্থির ও প্রশান্ত যেন। চোখের প্রাবল্য যেন বেশ অস্থিরতা উৎপাদক। দর্শনেন্দ্রিয় তুলনামূলকভাবে আগ্রাসী, সে সহজে দখল নিতে পারে অন্য সব ইন্দ্রিয়ের ওপর। শ্রবণেন্দ্রিয় বোধ হয় এতটা দখলকামী ও সর্বগ্রাসী নয়।

কলকাতা বেতারে একটা নাটক শুনেছিলাম। এক বিজ্ঞানীকে নিয়ে। তিনি এক যন্ত্র আবিস্কার করেছিলেন, যেটি দিয়ে শোনা যেত শ্রুতিপূর্ব ও শ্রবণাতীত শব্দও। দুর্বিসহ হয়ে ওঠে ওই বিজ্ঞানীর জীবন। জাগতিক ও মহাজাগতিক নানা শব্দ অসম্ভব করে তোলে তার বেঁচে থাকা। থিয়েটারের জন্য লিখিত নাটকগুলোই রেডিওতে প্রচারিত হতো প্রথম প্রথম; তাছাড়া গল্প-উপন্যাসকেও নাট্যরূপ দেয়া হতো। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ও ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে শুধু রেডিওর জন্যই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাটক রচিত হয়। বেকেট লেখেন All that fall, হ্যারল্ড পিন্টার লেখেন a slight ache, ডিলান থমাসও লিখেন রেডিওনাট্য।

বেকেটের রেডিও নাটক Ember পুরস্কারও পায়। বিবিসি অজস্র সফল রেডিও নাটক প্রচার করে। আমাদের দেশের বড় নাট্যকার বা কবিরা রেডিওর জন্যে নাটক লিখেছেন কিনা জানা নাই। রেডিও ফিকশনের/অডিও ফিকশনের যুগ পুনর্জীবিত হতে পারে কি? রেডিও নাটকে দৃশ্যসজ্জা লাগে না, কিন্তু রেডিও নাটকের আপাত সরলতার ভেতরেও আছে জটিল গ্রন্থি, বিশেষ করে স্বর ও শব্দ সংযোজন, কণ্ঠের ওঠানামা, শব্দ দিয়ে আবেশিত করে ফেলা দৃশ্যমাধ্যমের চেয়ে কম উপভোগ্য নয়। শ্রুতি মাধ্যমে শ্রবণ ও কল্পনা একসাথে চলে। এলিয়ট একটু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে একে Auditory Imagination বলেছেন। মুখে মুখে আদি কাল থেকে গল্প `বলা` ও `শোনা`র যে টান টান প্রত্নস্মৃতি, তা এই বেতার মাধ্যম যেন জাগিয়ে রাখে শ্রোতার মনোজগতে ধ্বনির আবেশে। দৃশ্যমাধ্যম দ্রষ্টার কল্পনার এই অবারিত পরিসরকে সংকুচিত রাখে।

প্রযুক্তির বিবর্তন, শিল্প-উপভোগের এই রূপান্তর দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে হয়তো আমাদের চৈতন্যের ইতিহাস। রেডিও থেকে সাদাকালো টিভি, রঙিন টিভি, ভিসিয়ার, ভিসিডি, ডিভিডি হয়ে ইউটিউবে ঠেকেছে বিনোদন মাধ্যম। এই যন্ত্রনির্ভর বিনোদন ব্যবস্থায় সবচেয়ে প্রাচীন হলো এই রেডিও। রেডিও নাটকের পুনরুজ্জীবন একসময় হবে বলে মনে হয়। দৃশ্যমাধ্যমের ক্লান্তি শেষে একটু প্রশান্তির অন্বেষণে রেডিও মাধ্যম ফিরে আসতে পারে আবার। আশা করতে দোষ কি?

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক