হুজুরূপী কিছু মানুষের মুখোশ খসে পড়লে শয়তান বেরিয়ে আসে

সাইফুল জার্নাল

প্রকাশিত : মে ২৭, ২০২১

শৈশবে ভোরবেলা উঠে মাথায় টুপি দিয়ে, সিপারা হাতে নিয়ে, নামাজের পাটি বগলে করে ভাইদের সাথে মক্তবে পড়তে যেতাম। মক্তবে গিয়ে যার যার পাটি বিছিয়ে নিতাম। কেউ পড়তো আর বেশির ভাগই গল্প ও দুষ্টুমি করতো। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় আরবি গামছা আর পরনে লুঙি, পায়ে রাবারের সু, কাঠের ডাটির ছাতা হাতে পঞ্চার্শোধ মেছাব (হুজুর) ঢুকতেন মক্তবে (টিঅ্যান্ডটির পরিত্যক্ত ভবন)। আমরা আকারে ছোট ও বসে থাকার কারণে উনাকে বেশ লম্বা লাগতো। শ্রদ্ধা আর ভয়ে তাকে দেখে সবাই সালাম দিতাম আর যে যার কিতাব নিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকতাম।

সবার সাথে মাথা ঝাকিয়ে আমিও সুর মিলিয়ে শব্দ করতাম। মেছাব একে একে সবার পড়া ধরতেন। ঠিকঠাকভাবে না পাড়লে বাঁশের কঞ্চির বাড়ি সুনিশ্চিত। তার জন্য আমি একটু ভয়ে থাকতাম। একটা সময় পর্যন্ত হুজুর আমার পড়া ধরতেন না (তখনো আমি দুধভাত!)। দুষ্টুমি করলে কিছু বলতেন না। বরং আদরটাই করতেন পারিবারিকভাবে চেনাজানার কারণে। মক্তবে আসতে যেতে ভালোই লাগতো।

একদিন  হুজুর একটি ছেলেকে মেরে দুটো বাঁশের কঞ্চি ভাঙলেন। ভয়ে পরদিন থেকে আমি মক্তবে যাওয়া বন্ধ করে দিই। মাসশেষে হুজুর আমাদের বাসায় আসতেন মক্তবের বেতন নিতে। আম্মা উনাকে চা নাস্তা দিতেন, মাসলা মাসায়েল নিয়ে নানান প্রশ্ন করতেন। মেছাব তার জানার মধ্যে যথাসাধ্য উত্তর দিতেন। আম্মা  নানাবাড়ির খোঁজ খবর নিতেন। সবশেষে মেছাব পানের বাটা থেকে পান নিয়ে বিদায় নিতে থাকতেন, আম্মা তখন রোল করা কিছু টাকা মেছাবের হাতে দিতেন মাসের বেতন হিশেবে। কথাপ্রসঙ্গে আমি কেন মক্তবে যাই না, এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন মেছাব। আম্মা বলেন, হুরুত মক্তব যাইতঅ ডরায়,বড় হইলে যাইবো নে।

আমার বলা শাস্তির ঘটনাটা আম্মা মেছাবকে বলেন। মেছাব শাস্তি দেবার কারণটা বলেন, একটা মেয়েকে উত্যক্ত করার দায়ে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির পুত্রকে শাস্তি দেবার পর তার বাবা বলেছিলেন, পরের বার হাড় মাংস আলাদা করে বাড়িতে পাঠাবেন।

মেছাব চলে যাবার পর আম্মা বল্লেন, খারাপ কাজ করলে মেছাব শাস্তি দেন আর সেটা গিয়ে শয়তানের গায়ে লাগে, তখন শয়তান আর কাছে আসতে সাহস পায় না, তখন মানুষ ভালো হয়ে যায়।
এরপর থেকে মেছাবকে আর ভয় পেতাম না। নিয়মিত সহোদারদের সাথে মক্তবে যেতাম। অনুষ্ঠানিকভাবে সিপারা শেখা শুরু করি।

একসময় আমাদের বাসার পাশেই উপজেলা কমপ্লেক্সে কোর্ট মসজিদ তৈরি হয়। সেখানে এক হুজুর আসেন, গোলগাল চেহারায় সুন্দর দাড়ি, পোশাক আরো সাদা আরো সুন্দর। শরীর থেকে অদ্ভুত রজনিগন্ধা ফুলের সুবাস আসে। নামাজের সময় সূরা পড়েন একটু ভিন্নভাবে, একটু ভিন্ন সুরে। সূরার আয়াতের বিভিন্ন স্থানে জোর দেন, কখনোবা নাকে নাকে বলেন। মুসুল্লিদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন। দূর থেকে তাকে দেখতাম। জানলাম, শহরের পাশের গ্রামেই তার বাড়ি। পড়াশোনা করেছেন জেলা শহরের বড় মাদ্রাসায়। উপজেলার সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী ও পাশের পাড়ার শিশুদের কোরআন শিক্ষা দেবার জন্য মক্তব খোলা হলো নতুন মসজিদে।

নতুন হুজুরকে অনুরোধ করা হলো, পড়ানোর জন্য। নতুন মসজিদ, মক্তব আর সুন্দর মিষ্টি হুজুরের কাছে পড়তে থাকলাম। যত্ন সহকারে উনি পড়াতেন। তিনি মক্তবে পড়ার পাশাপাশি ফুল বাগানে পরিচর্যা সাপ্তাহিক মসজিদ পরিচ্ছন্ন করা এসব কাজেও আমাদের উৎসাহিত করতেন। বিনিময়ে সবার জন্য সুপার বিস্কুট (আটা চিনির বিস্কুট) দিতেন। শিশুদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করেতেন। বড়রাও উনার সাথে সময় নিয়ে কথা বলতো। ভালো থাকা, সুস্থ জীবনযাপন এবং হালাল আয়ের ব্যাপারে সবাইকে পরামর্শ  দিতেন। বলতেন, ধৈর্যধারণ করা, আল্লার ওপর ভরসা রাখাই মানুষের কাজ। জিকির আসগার, তসবিহ্ তাহলিল, মানুষয়ের মুক্তি ও ধর্মের কথা ছাড়া অন্যকোনো বিষয়ে উনাকে কথা বলতে শুনিনি।

আমরা কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতাম আবার মসজিদেও সময় দিতাম। তাই দেখে কেউ কেউ বলতেন, ‘নাটইক্যা ফুলাইন মজ্জিদ কিতা করে?’ হুজুর বলতেন, তারা তো আর চুরিচামারি নেশাপানি করে না। নাটক টাটকেরও দরকার আছে। একসময় বুঝ হলে তারা ছেড়ে দেবে।

আমাদের শৈশবের মেছাব-হুজুর-বড় হুজুর-হাফিজ্জি হুজুর (কোরআনের হাফেজ)-ছোট হুজুর তাদেরকে কখনো কুবুদ্ধি-কুশিক্ষা দিতে দেখিনি, কুচিন্তা করতে দেখিনি, শয়তান থেকে তারা দুরে থাকতেন এবং শয়তানকে তারা দূরে রাখতেন।

আমাদের শৈশবের মেছাব হুজুরদের সংখ্যাটা হয়তো কমে গেছে। আজকাল প্রায়শই ইসলামের লেবাসধারী হুজুরূপী কিছু মানুষ দেখা যায়, যাদের মুখোশটা খসে পড়লে শয়তান বেরিয়ে আসে।

আর খবরে প্রকাশ হয়, শিশুকে আরবি পড়ানোর সূত্রে মায়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক, বাবাকে খুন। মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে ছয় টুকরো করা লাশ উদ্ধার। সূত্র: ২৬ ও ২৭ মে ২০২১ সালে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকা। (ঢাকার দক্ষিণখানের সংবাদ)

ধবধবে পোশাকের স্মিত হাসি আর সুগন্ধির সুবাস ছড়ানো আমার শৈশবের ফেরেশতারা হয়তো তখন লজ্জাই পান।

লেখক: অভিনেতা ও নির্মাতা