অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট: আর্ট আর পলিটিক্সের ডাইলেক্ট

মৃদুল মাহবুব

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০১৮

শুয়ে ঘুমিয়ে আলস্য করে করে ঋত্বিক ঘটকের `অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট` পড়ে ফেললাম। মঞ্চ, নাটক, সিনেমা নিয়ে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে কাজ করে তাদের জন্য প্রাইমারি বই এটা। যারা এই সমস্ত নিয়ে কাজ করেন, ভাবেন তাদের পাঠ্য বইটি। শুধু নাটক, সিনেমা বলে কথা না বা এই উপমহাদেশের শুধু কমিউনিস্ট শিল্পী না বরং যারা বাংলাভাষী শিল্পচিন্তক, রাজনীতিবিদ বা সামাজিক দায়-দায়িত্ববান বা না-দায়িত্ববান কবি সাহিত্যিক তাদের অন্তত একবার পড়া লাগে। আমার মত যারা সো কল্ড পুঁজিবাদী চিন্তা থেকে শিল্প সাহিত্য করতে চায় তাদের জন্যতো এটা অবশ্য পাঠ্য। আমি নিজেকে পুঁজিবাদী বলেই পরিচয় দেই। বাংলা ভাষার শিল্পী সমাজের জীবন ও যাপন ক্যাপিটালিস্ট ধারার, কিন্তু চিন্তায় তারা কমিউনিস্ট ছদ্মবেশী। তাদের শিল্প সাহিত্যের বহু দায়, তাদের আছে শ্রেণী-কৌশল, ক্ষেত্র বিশেষে ঘৃণা, তাদের আছে সমাজ পরিবর্তনের কসরৎ। এর কারণ কী?

এর কারণ দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট উত্থান ও শাসন। সেদেশের সাহিত্য নায়কদের বেশির ভাগই সফল সমাজতান্ত্রিক, ক্ষমতা ঘেঁষা। আমাদের অনেক সাহিত্যিক পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত। যত কথাই বলি আমরা আমাদের লেখকদের বিরাট একটা অংশ কলকাতার বাই প্রোডাক্ট অনন্ত উপন্যাস ও কবিতায়। শুধু মাত্র হুমায়ূন আহমেদ বিরাটভাবে এই চর্চার বাইরে ছিলেন। আর যে কয়জন ছিলেন তারা তেমন একটা সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারে নাই প্রতিভার জোর না থাকার কারণে। হুমায়ূন মূলধারার সাহিত্যে স্থান পায় না বামাচারের কারণে। সিরিয়াস সাহিত্য একটা বিরাট বাজে ব্যাপার এবং ব্যাপক অপচয়ময় বিষয় আমার কাছে। আমাদের সিরিয়াস লেখক বলতে যা বোঝায় তারা কোনো না কোনোভাবে চিন্তায় বাম। কিন্তু ১৯৭১ এই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের কোনো চর্চা বা ভূমিকা নাই। সমাজতান্ত্রিক বহু দল থাকলেও সেই অর্থে তাদের তেমন উচ্চাশা নাই ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে। তারা সমালোচনায়রত থাকা একদল আদর্শবাদী মানুষ। তাহলে লেখকরা কোন কেবলার জোরে এই বাংলাদেশে বাম থেকে যায়? তাদের প্রণোদনা কোথায়? যে সমাজে যার চর্চা নাই তা আমাদের স্বপ্ন হলো কীভাবে? আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই সবল ও শেষ বাম লেখা তার তৈরিকৃত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাহিত্য নিয়ে। এর কারণ স্থূলভাবে বলা যায় দুইটা। সূক্ষ্ম কারণ থেকে স্থূল কারণ দিয়ে সাহিত্য বিচার ভালো, কেননা সেই বিচার কাজে সূক্ষ্মভাব ভাব তেমন একটা চলে না। এক. দেশ ভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ ফেরত সাহিত্যিকদের বাম দুর্বলতা যার প্রভাব এখনো সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্য করতে উদ্ধুদ্ধ করে। দুই. আমাদের লেখকদের নায়করা থাকেন ঐ কলকাতার ভদ্র সাহিত্য পল্লীতে। তারা যেমন লিখতে চান মনে মনে তারাও তাই লিখতে চায়। এই সব বাদ দেয়ার সময় সমাগত।

কলকাতায় যেহেতু বামের বিজয় চলছে বহুদিন সেজন্য তাদের বইয়ের দোকানে বাংলাদেশের বাম ধারার লেখক ইলিয়াসের দুইটা মোটা উপন্যাস পাওয়া যায়। তা না হলে এও ওপারে যেত না। কলকাতায় যেদিন বিজেপি ক্ষমতায় যাবে সেদিন থেকে এই সমস্তের কাটতি কমবে। এইটাই সেই দেশের পুস্তক ভোক্তাদের রাজনীতি প্রাদেশিক বাংলা ভাষায়। তারা ঠিক। আমাদের বেশির ভাগ লেখক সমাজ চিন্তায় বামপন্থী, তারা মুখে সমতা চায়, কিন্তু তাদের কোন কাজ নাই তা নিয়ে। এর কারণে কলকাতার রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ঢাকাই সাহিত্য ফলানো। এই বাংলার সব লেখকদের হিরোতো ঐ বাংলায়। ফলে তাদের নায়কের মত স্টাইল করে বিপ্লবের লাল জামা গায়ে দেয়। লেখকরা সব সময় ক্ষমতা কাঠামোর সাথেই থাকতে চায়। কলকাতার লেখকরা জানতো কমিউনিস্ট বিপ্লব আসন্ন। ফলে তারা বাম রাজনীতির সাথেই ছিলো। সেই কারণেই লেখক হিসাবে তারা সমাজতন্ত্রের সমালোচক ছিলো না। তাদের সাহিত্যে সে সমস্ত নাই, খুঁজে দেখবেন। শুধু মানুষ মানুষ হৈচৈময় কবিতা, উপন্যাস তাদের বামপন্থী সাহিত্যিকদের। আর আছেটা কী! বিষয়গুলো ঋত্বিকের বইয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও বলে রাখা ভালো পন্থাবাদী সাহিত্যের প্রভাব ও ফলাফল দেখার জন্য। ‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’ শতভাগ তাত্ত্বিক পুস্তক। বহুকিছু অস্যামশন হিসাবে দেখার সুযোগতো আছেই। মোদ্দা কথা, ঋত্বিককে ঋত্বিক হিসাবে বিশ্বাস করার কারণ নাই তেমন এই বইয়ে।

পন্থাবাদী শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম মায়েস্ত্রো ঋত্বিক কুমার ঘটক। তিনি সমাজতন্ত্রের পেটের মধ্যে বসে তার প্রতি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ‘‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’’ বইয়ে তা আর কার মধ্যে আছে যখন ১৯৫১ সালে যখনও বিপ্লব প্রতিষ্ঠা হয় নাই? এবং আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করার মত। এই সমালোচনা মূলক আলোচনার পর পার্টি থেকে বের হয়ে যেতে চান নাই স্বেচ্ছায়। তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার কারণ এককভাবে এই বইটি না বলেই মনে হয়। কারণ ঋত্বিক যতটা মানুষ বাকিরা ততটাই আদর্শবাদী। আরো কয়েকটি বিষয় স্মরণ রেখে এই বইটি পড়া দরকার। ১৯৫৫ সালে ঋত্বিক দল থেকে বহিস্কৃত। ১৯৬০ সালে তার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ১৯৭৭ সালে ‘যুক্তি তক্কো ও গল্প’ রিলিজ পায়।

‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’ হলো কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক লাইন নিয়ে ঋত্বিকের ১৯৫৪এ ইংরেজিতে লেখা একটা থিসিস। ঋত্বিক পার্টি থেকে বহিস্কৃত হবার পর এই দলিলের আর খোঁজ ছিলো না। ১৯৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক্স মূখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তরে ঋত্বিক স্বাক্ষরিত দলিলটি খুঁজে পান। ১৯৯৬ সালের আগে সাধারণের এটা পড়ার সুযোগ ছিলো না।

ধরা হয় ঋত্বিককে পার্টি থেকে বের করে দেবার পেছনে অন্যান্য নানা কারণের সাথে এই বইয়ের পরোক্ষ কারণ আছে। এমন শুনেছি। তবে দল থেকে বহিস্কৃত হবার পর তিনি ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কমিটি, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার কাছে আত্মপক্ষের ব্যাখ্যামূলক একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেটা পড়ে যা যা কারণ পাওয়া যায় তার মধ্যে এই দলিলের তেমন কোন উল্লেখ নাই। তবে সেই সময়ের পার্টির নেতাদের কর্মপদ্ধতি, শিল্প ও শিল্পীকে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো তার প্রতি সমালোচনা মূলক অনেক কথাই তিনি লিখেছেন এই বইয়ে। তত্ত্বগত জায়গা থেকে তিনি বরং শার্প তাদের থেকে। এবং তারা পার্টির কালচারাল ফ্রন্টগুলোকে সেকেন্ডারি উইংস হিসাবেই দেখতো। ঋত্বিকের মত আরো বহু শিল্পী বিপ্লবীরা যে দলের দ্বিতীয় কাতারে তা দলিল পড়ে বোঝা যায়। যদিও রাজনীতির মাঠে শিল্প দ্বিতীয় কাতারেই থাকবে। আর সমাজতন্ত্রে শিল্পের অবস্থান অন্ত্রেরও নিচে।

বড় ঘটনা হলো, ঋত্বিক শিল্প নিয়ে যা ভাবতেন ও বিশ্বাস করতেন, তা যদি ভেঙে বের না হতে পারতেন তবে তিনি ঋত্বিক ঘটক হতেন না। যে ঋত্বিককে দেখা যায় ১৯৬০ এর পর থেকে তা তার ‘‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’’ কে অস্বীকার করেই সৃষ্টি হয়েছে। এই লেখা বামধারার শিল্প চেতনার প্রাথমিক ম্যানডেট যা তিনি ভবিষ্যতে উৎরে গেছেন। তিনি মতাদর্শের কাছে বন্দি থাকেন নি। ভারতের রাজনীতিতে গান্ধী যেমন, সাহিত্যে বঙ্কিম যেমন, চলচ্চিত্রে ঋত্বিক কুমার ঘটক তেমন। ‘‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’’ এর ভাঙ্গন ছাড়া এমন মহৎ সিনেমা তৈরি হয় না। এই কারণে এই ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র বোঝার জন্য যেমন একজন ঋত্বিক অবধারিত, তেমনি ঋত্বিক বোঝার জন্য ‘‘অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট’’ আবশ্যক।

দল, পার্টি, আদর্শের মায়াজাল দিয়ে শিল্প সাহিত্য হয় না। কিন্তু এগুলো দিয়ে রাজনীতি হয়। ঋত্বিক দল থেকে বহিষ্কৃত, কিন্তু তিনি শ্রেষ্ট চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে অন্যতম। এটাই আয়রনি। দল তাকে বের না করে দিলে তার এই সমস্ত সিনেমা হতো না। আর দল থেকে তাকে বের না করে দিলে কমিউনিষ্ট পার্টি রাজ্য ক্ষমতায় যেত না। এটাও আরেক আয়রনি। ঋত্বিকদেরকে দল থেকে বের করে দিয়েই রাজনীতি চালাতে হয়। রাজনীতি এমনই। রাশিয়া, চীনের উদাহরণ টানার দরকার নাই আপাতত। যত বিপ্লবী রাজনৈতিক দলই হোক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল। শিল্পী আর লেখকরাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিপ্লবী। মার্ক্স নিজেও দার্শনিক ও লেখক। তিনি রাজনীতিবিদ না। সেই কারণে তিনিও বিপ্লবী। তার ফলোয়ার লেলিন, মাও বহু ক্ষেত্রেই রক্ষণশীল, সফল রাজনীতিবিদ, ননআর্টিস্ট। এইটাই হলো আর্ট আর পলিটিক্সের ডাইলেক্ট। এটা আমাদের খেয়াল করতে হবে। এই দ্বন্দ মেটার না। এই কারণে গান্ধী রাজনীতিবিদ, রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিম সাহিত্যিক, ঋত্বিক সিনেমাওয়ালা।

একুশে বইমেলা ২০১৮