অপমানবোধ থেকে হৃদয়ের আলাপ

যিয়াদ বিন সাঈদ

প্রকাশিত : মে ২৩, ২০১৮

প্রথম যেবার মসজিদে তারাবিহ  পড়ানো শুরু করেছিলাম, গল্পটা সে সময়ের। এটা মূলত গল্প কীনা তাও ভাবলাম একবার। সবকিছুই কি গল্প? আরে হ্যাঁ, জীবনের  নাট্যমঞ্চে যা করছি, সবই তো গল্প। কিছু গল্প মানুষের সঙ্গে মিশে থাকতে পারে, আর কিছু হারিয়ে যায়। যেগুলো মিশে থাকে কল্পনাতীত ভাবে, সে থেকেই মূলত আমাদের হতাশা কিংবা মনোবলের সৃষ্টি হয়। যাই হোক, মূল কথায় আসি।

তারাবিহ কয়েকদিন পড়ানোর পর একদিন হঠাৎ করে কী যেন হলো, সভাপতি সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশে কিছু বলবেন। নামাজের আগমুহূর্ত। আমার বুকে প্রতিদিনই এ সময়টাতে ধুকপুক করতে থাকে। তো সভাপতি সাহেবের এ আচমকা মাইক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা আমাকে তেমন স্পর্শ করলো না। স্বাভাবিক কিছু হবে হয়তো। পেট ভাসিয়ে চলা কিছু লোক আছে না? উনি এরকমই। বেঁটেমতো এক পুঁচকে লোক। ঘন গোফ। কপাল অলওয়েজ কুঁচকে রাখা তার স্বভাবগত অভ্যাস। তো তিনি হামদ ও সালাতের পর হুজুরদের মতো দীর্ঘ আলাপের সূচনা করলেন।

তো মুসুল্লিয়ানে কেরাম, আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করতেছি যে, তিনি আমাদিগকে এমন এক বরকতপূর্ণ কাজ করবার তওফিক দিছেন। রমজান মাস, বড়ই বরকতের মাস। একটি নেক আমলে সত্তরটি আমলের সওয়াব। তো যেটা বলার, রমজানের পর আমাদের সামনে ঈদ আসন্ন। আর ঈদ তো এ জন্যেই যে আমরা সকলেই যেন ধনী-গরিব নির্বিশেষে একটি আনন্দের দিন একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারি। আপনারা সকলেই জানেন, আমাদের মসজিদে তিনজন কুরআনের হাফেজ তারাবিহ পড়াচ্ছেন। আপনাদের যেমন ঈদ আছে তাদেরও তো আছে, নাকি? তারাও চায় ঈদের দিন একটু ভালো কাপড়-চোপড় পরে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করতে। তাই আমাদের কর্তব্য, তাদের এ আনন্দের জন্যে একটু তৎপর হওয়া। সকলেই যদি এগিয়ে আসি, তাহলে হয়তো তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানো সম্ভব। তো ভাই সবাই প্রস্তুত আছেন তো ইনশাআল্লাহ।

সভাপতি সাহেবের কথা চলাকালীন আমি একবারের জন্যও মুখ আর ওঠাতে পারলাম না। সেদিন তারাবিতেও লোকমা গেল অনেকগুলো। নামাজ শেষে বের হবার সময় মুসল্লিদের মুখেও আর আগের মতো অবয়ব দেখা গেল না মনে হলো আমার। কী বিচ্ছিরি। ছিহ! আমাদের ঈদে ভালো কাপড়-চোপড়ের জন্যে কীনা মুসল্লিদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয়া লাগবে! কোরআনের বাহক হিসেবে যে সম্মানবোধ আমার নিজের প্রতি ছিল, সেটা অনেকটা লোপ পেতেই শুরু করেছিল বোধহয়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদেই হাফেজদেরকে এ অবস্থানে ফেলে দিয়ে কমিটির লোকজনেরা এ কালেকশন করে থাকে। ভাবি, তখন কি এসব হাফেজদেরকে অপমান করা হয় না? পা চাটতে আসছি? অসহ্যরকম এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমার তিনটি বছর কেটেছিল। কিন্তু বাস্তব সত্য যেটা, আমি সে মসজিদ থেকে এক পয়সাও নিতে পারিনি। আমার আব্বুর নিষেধ ছিল। পয়সা নিই আর না নিই, মুসল্লিরা কি তা জানতো? নিশ্চয়ই না। হালে চড়ানো গরুকে রাতেরবেলা আহার দেয়ার মতোই গরুর সফফে আমাকে ফেলে দিয়েই তারা পয়সা দিত। দিনশেষে দেখা যেত, ফলাফল শূন্য। অপমান ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

এবার যেদিকে পড়াচ্ছি, এখানে আব্বুর ত্রিশ বছরের অধিক সময় কেটে গেছে। একবারও কোনো মুসল্লি টাকা দেয়ার সাহস করে নাই। কমিটির কালেকশন তো দূর কি বাত। টাকার প্রতি আমার লালসা যে নেই, এমন পবিত্র রূপ দিয়ে নিজেকে প্রেজেন্ট করার কোশেশ আমার নেই। আমি জানি, টাকা আমি ভালোবাসি। কিন্তু কোরআন বেঁচে? কোরআনকে পণ্য করে এ এক-দুই পয়সা দিয়ে আমার কী লাভই হবে? শত শত মুসল্লির কাছ থেকে অসংখ্য অপমানের পেয়ালা নিয়ে ঘরে ফেরা ছাড়া আর কিছুই না এটা। এ থেকে সরে আসার জন্য বিপ্লব কায়েম করুক হাফেজরা। নিজেদেরকে চিনতে শিখুক। কে তারা? কোথায় তাদের মাকাম!