অবরোহী

উপন্যাস ২

আশাজ যুবায়ের

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০১৯

অদৃশ্য থেকে ভেসে আসে অনুরোধের স্বর, `তোমার স্মৃতিগুলো তো আমাকে জানাতেও পারো। শুনে হয়তো তোমার সঙ্কট নিরসনের একটা উপায় কল্পনা করা গেল। তাছাড়া ফিরে যাওয়া, না-যাওয়াও তো প্রশ্ন সাপেক্ষ। সময়টার সহি ব্যবহার হওয়া দরকার। কী বলো?`

শ্রোতা যখনই কিছু জানতে বারবার আগ্রহ দেখায়, অপর পক্ষের ভাব তখন ঊর্ধ্বগগনে ওড়ে। সে চায়, ‘বলেই যাক না, ভালোই তো লাগে।’ এর পাশাপাশি আবার ভাবটাও উভয় সঙ্কটে ভোগে, যদি আর না-বলে, যদি এবারই শেষবার হয়। হয়তো সে চিন্তায় সম্মতির কৃত্রিম ঢঙে শ্রোতার মনযোগ ধরে রাখতে চায়। এধরনের মুহূর্ত অবশ্য নিতান্তই নব-প্রেমের ক্ষেত্রে ঘটে। তবে হ্যাঁ, এ কথাও সত্য, জগতে নারীর যদি ঢং না থাকতো তাহলে পুরুষেরা অনেক আগেই আগাম মৃত্যুর প্রস্তুতি নিত।

অবরোহী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ঊর্ধ্বমুখী সুউচ্চ দেবদারু গাছগুলোর ডালপালা থেকে মৃদু হাওয়া ফিরে ফিরে ওর ললাটে পড়ে থাকা বাঁদিকের চুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের উড়ো চুলের সৌন্দর্য হৃদয়ে আবেগের অন্যরকম অভ্যুত্থান ঘটায়। শুধু তাই নয়, ঠোঁটের কিনার ছুঁয়ে থাকা কিঞ্চিৎ উঁচু দাঁতটা হাসতে গিয়ে বের হওয়া, চওড়া চোখ দুটো সময় নিয়ে মোড়ানোর নখড়া। `এ ধরণের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে সবাই বিনাপ্রশ্নে আবেগাপ্লুত হবে। বিশেষত যাদের হৃদয়ে সামান্য প্রাণ আছে। মুহূর্তগুলো দেখতে রোমিও, মজনুরাও পুনরায় জীবিত হবার আপ্রাণ চেষ্টা করত এবং স্রষ্টার কাছে অনুপম ঢঙগুলো করুণা চাইতো।’

‘কথায় কথায় অত রোমিও, মজনুদের উপমা টানতে হবে কেন? আপনার প্রেমের অনুভূতিগুলো কী একদমই অনর্থক? না, মোটেও না। হয়তো আপনার প্রেমের না-জানা উপাখ্যানটা এতটাই আবেগঘন যা ভাবতে রোমিওরাও নিজেদের চরম অযোগ্য মনে করে নিত। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? ওদের প্রেমের মিনতিটুকু সময় গ্রহণ করেছে আর আপনারটা হয়তো সময়ের দেউড়িতে পৌঁছবার আগেই হারিয়ে গেছে। যদি এমন না হতো, হয়তো আপনার প্রেমের নীল-উপাখ্যানটাই যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে পৃথিবীজুড়েই মঞ্চায়িত হতো। তারই অপর নাম হতো ইতিহাস। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, সময়ই জগতের পুরনো কবি।’

গলা ঝেড়ে ধীর গলায় অদৃশ্য বলল, `অবরোহী, তুমি ওই দিঘির পাড়ে বসো। স্থির হও। আশা করব, এতে তোমার কোনো দ্বিরুক্তি থাকবে না।`

ও সামান্য স্বাভাবিক হয়ে, হেঁটে গিয়ে বসসো। দিঘিটা এত চওড়া যে, আয়ত্বে আনতে কয়েকটা পলক লেগে যাচ্ছে ওর। সফেদ-রাজহাঁসগুলো গভীর মনোযোগে মাথা চুবিয়ে পানি ওঠাচ্ছে এবং নাক থেকে ফোয়ারার মতো ছুড়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাজটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে করছে। এদিকে আকাশের রঙের প্রভাব পানিতেও ছেয়ে গেছে। গাঢ় গোলাপি রঙের দোপাট্টাগুলো উড়ছে ডানপাশে; ওগুলো নাকি পরী-রাণীদের, ঠিক উল্টোদিকে উড়ছে গাঢ় সবুজ দোপাট্টা। এগুলো নিশ্চয়ই পরী-পত্নীদের! ওরা সম্ভবত জলকেলি করে শুকোতে দিয়েছে। দিঘিতে ফোটা পদ্মগুলোর রঙ নীলের কাছাকাছি। অথচ নীলও নয়। কেমন যেন অপ্রকাশ্য রঙটা, যার বিবরণ এ মুহূর্তে অবরোহী দিতে পারবে না। হয়তো আরো কয়েকটা দিন সময় লাগবে ওর।

দিঘি থেকে চোখ সরিয়ে সে অদৃশ্যকে বলল, ‘একটা সিগারেট হবে?`
অদৃশ্য হিহিহি করে হেসে বলল, `তুমি সিগারেটও খাও নাকি?`
‘না, তা নয়। তবে নয়ন-টোটনের সঙ্গে কয়েকবার পাটখেতে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়েছিলাম। প্রথমবার খেয়ে পুরো আকাশটা ঘুরে মাথায় পড়ছিল, আর নয়ন প্যাক প্যাক বমি করে ফেলেছিল।

অদৃশ্য হেসেই কুটিকুটি, `নয়ন-টোটন? ওরা কারা?’ অবরোহী কথা শুনে যেন সে আকাশ থেকে পড়ল। মনে ওর প্রশ্ন প্রদক্ষিণ করছে, ওদের চেনে না? এটা কোনো কথা? আজব তো! ওরাইতো আমার বন্ধু-ভাই যাই বলি না কেন, সব তো ওরাই। আপন মনের বলয়ে অনেক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল উত্তরটা খুঁজতে। কিছু সময়ে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো না-জানা নীরব ও ভয়ংকর অপরাধও বটে। ভাবনা থেকে ফিরেই,`এম্মা ওরাই তো আমার বন্ধু।আপনি জানেন না? অহ, আপনি কি করে জানবেন? ঠিকি আছে, ঠিক আছে। আপনি তো আর আমাদের গাঁয়ের নন। কথাগুলো বলেই লম্বা দমটা ফেলে, `আমার না খুউব ইচ্ছে করত, গোল হ্যাট মাথায় দিয়ে পায়ের ওপর পা রেখে বাবুদের কায়দায় সিগারেট টানতে। কিন্তু পারতাম না। আমিতো মেয়ে, তাই! একবার কী হলো শুনেন, গাঁয়ে কয়েকটা ফিরিঙ্গী আসলো। ওদের দেখলাম লাল-নীল প্যাকেট থেকে সিগারেট বেরকরে দুমছে টানছে। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। টোটনকে বললাম, যা তুই কুড়িয়ে নিয়ে আয় সবাই মিলে খাই। বেটারা এত কৃপণ! পুরো সিগারেট খেয়ে শুধু পাছাটা ফেলত। আমি খাব কী, ওরা খাবে কী? তাও আমি দুটো টান দিতে পেরেছিলাম। টানতে গিয়ে ঠোঁটে খুব গরম লাগল, মনে হলো পুড়েই গেছে। নয়নরা সে কী রাগ! বাবারে বাবা, তিনদিন তো কথাই বলল না কুত্তাগুলা।

আরে বাবা দুটো টানই না হয় দিয়েছে সেজন্য কথাই বন্ধ? পরে আমি আব্বার বিড়ি চুরি করে ওদের খাইয়ে সে রাগ নিবারণ করি। ছেলেদের সঙ্গে মিশবার জন্যে কী যে খারাপ খারাপ গালি দিত গাঁয়ের বুড়িরা! একবার পাশের বাড়ির কমলা দাদি, উনি অবশ্য আব্বার ফুপি, সে নয়নদের সাথে আমাকে ডাঙুলি খেলতে দেখে কী যে বিচ্ছিরি গালাগালি, ‘ধিঙ্গি মাগী, বইতাল মাগী,বেলাজা, বেহ্যাইয়্যা, বেশরমা, লজ্জাশরমের বালাই নাই। হারাদিন ছ্যামরাগো লগে গুরাগুরি...‘ গালি দিয়েই আবার আব্বার কাছে বিচার, ‘এ্যাই সিদ্দিক্ক্যা তোর মাইয়্যাডারে তাড়াতাড়ি বিয়া দে। শেয়ান অইছে। বিয়ার লায়েক অইছে। মাইনশে মুখ করব। মান যাইব।’ আব্বা হেসে উত্তর দিল, ‘আচ্ছা ফুপি।’

আব্বার হেসে উত্তর দেয়াটা দেখলে সব খারাপ লাগাগুলো নিমিষেই মিলিয়ে যেত। জগতের সমস্ত বাবাদের হৃদয়েই নাকি মেয়েদের জন্য মায়ার একটা আসন সংরক্ষিত থাকে। যেখানে মেয়েরা সমস্ত অভিযোগের আকুতি ঢেলে পরম শান্তির শ্বাস নেয়। পরের দিন আমি টোটনদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘বইতাল মানে কী রে? জানিস তোরা?’ আমি এই গালিটা সেদিনিই প্রথম শুনেছি। ওরা প্রশ্নটা মনোযোগ সহকারে শুনে, মাথা চুলকিয়ে, ঠোঁট কামরিয়ে বাধ্য ছাত্রদের মতো উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করছে। টোটন হঠাৎ বাঁ হাত উঁচিয়ে, আমি পারবো,আমি পারবো... নয়ন বলল, উহ, উনি পালবে! মিথ্যা কথা বলার জায়গা পায় না। সম্মান বাঁচাতে টোটন বলল, তুই ক তাইলে, আমি তো পারি না,ক.. ক।

অবরোহী দুজনকে দু`হাতে খোঁচা মেরে, `অ্যাই তোরা চুপ। বুদ্ধি দে তো বুড়িরে কী করা যায়? নয়ন, `উম... ঘড়ি ধইরা পয়তাল্লিশ মিনিট থাপড়ানো যায়।

অবরোহী, তুই কি মানুষ? মারাই তো যাবে অত মারলে। ছাগল জানি কোহানকার।
টোটন, তাইলে

চলবে