আমরা পাঠকও হারিয়েছি, দর্শকও হারিয়েছি

পর্ব ৯

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

 

সরফরাজ: সিনেমার কথাটথা যখন উঠলোই, কাদের সিনেমা ভালো লাগে সে বিষয়ে আমরা পরে আলাপ করব, এখানে একটা ব্যাপার জানতে চাইব, আজকের প্রজন্ম পড়ার চেয়ে দেখতে বেশি পছন্দ করে। হোক সেটা সিনেমা বা অন্য কন্টেন্ট। ব্যাপারটি আপনি কীভাবে দেখছেন?

মেহেদী: হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে একমত। এটা বড়দের বেলায় প্রথমে টের পাওয়া গেছিল বছর আট-দশ আগেই। হুট করে টিভি দেখার পরিমাণ বেড়ে গেছে, বিশেষ করে নিউজ, দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো বিটিভির সংবাদ কৌশল থেকে সরে গিয়ে একই সঙ্গে গতিময়তা ও কৌতূহল ধরে রেখে যখন থেকে সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছিল তখন থেকেই গৃহ-পরিসরে দেখার আমেজ ফিরে এলো। প্রথম প্রথম কোনো ঘটনার লাইভ সম্প্রচার জনমনে ব্যাপক উত্তেজনা আর বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছিল, এখনো সেটা ক্ষেত্রবিশেষে অটুট আছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে পড়ার চেয়ে দেখার আগ্রহ তৈরিতে নিউজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, হাতে সময় যা ছিল সেটা টিভির দখলেই চলে গেল। এছাড়া নতুন নতুন চ্যানেল আসায় অন্যান্য প্রোগ্রাম তো ছিলই।

সরফরাজ: ভালো পর্যবেক্ষণ!

মেহেদী: আর এভাবেই পরিবারের অভিভাবকদের মারফতই একটা প্রজন্ম, যাদের বয়স এখন দশ থেকে বিশের মধ্যে, তারা পড়ার চেয়ে দেখায় বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ল।

সরফরাজ: প্রক্রিয়াটা কেমন?

মেহেদী: এদের ডেভেলপমেন্টটা আবার ভিন্ন। এরা পুরোপুরি টিভি-কেন্দ্রিক নয়। এরা ইউটিউব-কেন্দ্রিক একটা জেনারেশন। সেইসঙ্গে এদের আছে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ফেসবুক। ইউটিউবের অগণিত কন্টেন্ট এদের মন যুগিয়ে চলছে। দেখার যে পরিসর তৈরি হয়েছিল নিউজ কেন্দ্রিক, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের রুচি তৈরির যে দায়িত্ব এদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর হাতে ন্যস্ত করেছিল, সে দায়িত্ব পালনে চ্যানেলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সে জায়গা নিয়ে নিয়েছে ভীনদেশি সিরিয়াল। ফলে আমরা পাঠকও হারিয়েছি, দর্শকও হারিয়েছি। মনে রাখতে হবে, মধ্যবিত্তের সময় বৈশ্বিক বাজারে নিলামে ওঠে এখন। তাদের সময়টুকু পেতে চাইলে সেভাবেই আন্তর্জাতিক হতে হবে। এরমানে এই না, সিরিয়াল আন্তর্জাতিক মানের কিছু। আসলে অপশন না থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে। দেশীয় চ্যানেলে দেখার মতো কিছু হলে দর্শক ফিরতে বাধ্য। সিরিয়ালের উত্তেজনা আর কৌতূহলকে অতিক্রম করে এমন কিছু বানানো গেলে দর্শক ফিরবে।

সরফরাজ: দেখা ও পড়ার ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

মেহেদী: নতুন প্রজন্ম পড়ার চেয়ে দেখে বেশি, এই ঘটনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন নই, চিন্তিত নই। তবে পর্যবেক্ষক। সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিবর্তন, বিবর্তন বা রুপান্তরকালীন সময়ের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এটা সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেখানে দেখার চল তাদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। এখন দেখার যুগ চলছে। তবে একটা সময় আসবে, যখন এটা বুঝতে সক্ষম হওয়া যাবে, দেখা এবং পড়ার অনুভূতি ভিন্ন, দেখার মাধ্যমে যে বোধ তৈরি হয় পড়ার মাধ্যমে নিশ্চই তার চেয়ে বেশি বোধ তৈরি হয়। তখন আবার পড়াতে ফিরে আসতেই হবে। লেখা যা দেখায় তা স্বাধীন, চিত্র যা দেখায় তা পরাধীন। আলাদা পাঠক নির্দিষ্ট একটি লেখা পড়ে আলাদা দেখার স্বাদ নিতে পারে, কিন্তু চিত্র যা দেখায় তাই দেখে প্রতিটি দর্শক। লেখার দেখা ও বোধ প্রত্যেকের জন্য আলাদা, চিত্রের দেখা একই, বোধ হয়তো আলাদা। ফলে পড়া এগিয়ে। আর দুটি মাধ্যম দুইরকমের। তুলনা দিলাম এজন্য যে, দেখা আমাদের প্রজন্মের পড়ার সময় আপাতত দখলে নিয়ে নিয়েছে। আলাদা মাধ্যম হিসাবে দুটির গুরুত্ব দুই ধরনের। সবচে বড় কথা, যা দেখানো হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা লেখা থেকেই বানানো। লাইভ নিউজ ও খেলা ছাড়া সবই লেখা থেকেই নির্মিত।

চলবে