অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৪

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি (পর্ব ৪)

নানাবাড়িতে এই মাছ ধরার ব্যাপারটা আমার শৈশবের এক ঝলমলে রুপালি স্মৃতি হয়ে আছে। নানাদের পুকুরে নানা বা কোনও মামা হঠাৎ-হঠাৎই একদিন ঝাঁকিজাল ফেলে শুরু করতেন মাছধরা। পুকুরের কিনার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুরো পুকুরটা চক্কর মেরে অবশেষে একটু কোমর পানিতে নেমে মাঝপুকুরেও ঝাঁকিজাল ফেলে কেঁচে আনতে চাইতেন পুকুরের সব মাছ। সেই ঝাঁকিজাল ফেলার মধ্যেও একটা আর্ট ছিল, দারুণ একটা ছন্দ ছিল। নাচের ভঙ্গিমায় জালটাকে সামনে থেকে ডানদিকে ছড়িয়ে দিতে দিতে তারপর আবার দেহটাকে এক জায়গায় স্থির রেখে জালটাকে আবার ডান থেকে পুরোপুরি বামে এনে যতদূর শক্তি পাওয়া যায় ছড়িয়ে উড়িয়ে ফেলে দেয়া হতো টার্গেট জায়গা মতো পানিতে। ছড়ানো জালটা পানির মধ্যে পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে আবার গুটিয়ে আসতো, সংকোচিত হয়ে আসতো। আর এ সময়েই সামনে পড়া মাছগুলোকে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিত নিজের অলক্ষ্যেই। তারপর জালটা যখন পানির নিচে থিতু হতো, ধীর স্থিরভাবে ওটাকে আস্তে আস্তে টেনে তোলা হতো। তখন উত্তেজনায় ধপ ধপ লাফাত আমার হৃদপিণ্ড! কী মাছ ওঠে, কী মাছ ওঠে কে জানে! জালে গেঁথে থাকা মাছগুলো দেখে কী যে এক অনির্বাচনীয় সুখ মনে দোলা দিত, তা কখনোই বুঝিয়ে বলার নয়। মলামাছের গা থেকে রোদে আশটের একটা রঙিন খুশি ঝিলিক মেরে উঠতো। ট্যাংরা, পুঁটি, খইলসা, মেনি, বাতাসি, চাপিলা মাছতো মিলতই, জালে ভেটকি মাছ উঠলে পাওয়া যেত রাজ্যজয়ের আনন্দ। ভেটকিকে আমার রুইয়ের মতোই লাগত। রুইকে সবাই বলত গরমা মাছ। খুব আভিজাত্য আর বনেদি ইমেজ ছিল রুইয়ের। সেটা শুধু ওর বাহ্যিক গড়নের জন্য নয়, ভেতরের গুণের কারণেও, স্বাদই ছিল আলাদা। আজকাল রুইয়ের সেই কৌলিন্য শুধু চেহারাতেই মেলে, স্বাদে খুঁজে পাওয়া ভার। চাষের রুইয়ের ভিড়ে নদীর সেই স্বাদভরা রুই আজ দুর্লভ হয়ে উঠেছে!
আমার শৈশবে দেশি মাছ ছাড়া আর কোনও বিজাতীয় মাছের অস্তিত্ব আমার চোখে পড়েনি। এই যেমন, তেলাপিয়া, নাইটিংগেল, কার্ফু কিংবা ক্যাপটেন এসব প্রজাতির মাছ। কত মর্যাদা ছিল রুই আর পাঙ্গাসের। নামিদামি আর অভিজাত মাছ বলতে এ দুটিকেই বোঝাত। আর ইলিশের কথা কী বলব! ওতো চিরদিনই বাঙালি সত্তার মর্মমূলে! যার কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজনই হয় না। কী নানার বাড়ি কী দাদার বাড়ি সবখানেই দেখেছি, হাটের দিনে বাড়িফেরতা মানুষগুলোর হাতে হাতে একটা কী দুটা কখনো বা আরো বেশি ইলিশমাছ ঝুলছে। তারপর দ্যাখো, সন্ধ্যার হওয়ার আগে আগেই ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো গ্রামময়!
নানা-মামাদের ঝাঁকিজালে রুই, ভেটকি ছাড়াও উঠত শোল, গজারও উঠতো। গজার মাছের ইমেজটা খুব ভালো ছিল না। মাংসের মধ্যে মহিষের মাংসকে যে চোখে দেখা হতো, মাছদের মধ্যে গজারকেও দেখা হতো একই চোখে। প্রায় প্রতিদিনই ধরা হতো মাছ। জালের মধ্যে সদ্য পুকুর থেকে ওঠানো টাটকা টাটকা নানা পদের মাছ দেখার অভিজ্ঞতাকে বলা যায়, অনেক খুঁড়েটুড়ে মাটির গভীর তল থেকে হিরে বা স্বর্ণ পাওয়ার মতোই বুঝিবা কিছু ঐশ্বর্যময় একটা দেখলাম। জালে তো আর রুপলি মাছ নড়ে উঠতো না, মনে হতো সমস্ত জীবনটাই বুঝি হঠাৎ হীরকখণ্ড হয়ে ঝলকাত। ঝাঁকিজালের এই মাছ মারার সময় আমার ভূমিকা থাকত, খালৈ হাতে নিয়ে নানা বা কোনও মামার পিছনে পিছনে সারা পুকুরপার ঘুরে বেড়ানো। এটাই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আনন্দের কাজ! খালি খালৈ একসময় মাছে মাছে ভরে উঠত। কোনও কোনও মাছ লাফিয়ে ঝাপিয়ে আমাকে অস্থির করে তুলতো।
একবার নানা আমার হাতে খালৈ ধরিয়ে দিয়ে নেমে পড়েছিলেন পুকুরের যে পাশটা টাগৈর আর কলমি মিলিয়ে জঙ্গল হয়ে আছে, সেখানকার কোমর পানিতে। পুকুরের সে পাশটার পাড় এতটাই জঙ্গলাকীর্ণ ছিল যে, সেদিকে যাবার কারো সাহস হতো না। ধইঞ্চা আর পিটকেলসহ নানা প্রজাতির গাছ মিলিয়ে ঘন ঝোপ হয়েছিল জায়গাটা। মাছতো মাছ, সাপেরও নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। আমার নানা জঙ্গলাকীর্ণ সেই জায়গাটার কাছে কোমরপানিতে নেমে আমাকেও ডাকলেন। আমি কী যাই! নানা হেসে হেসে অভয় দেন। এখনো তার চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভাসে। মাথার মাঝখানসহ প্রায় পুরোটাই টাক। কানের দু’পাশে কিছু চুল রয়েছে পাতলা পাতলা। খুব হাসতেন, কথায় কথায়ই হাসতেন, হাসির কারণে মুখের দু’পাশে বলিরেখা পড়েছিল। মৃত্যুও হয়েছিল হাসতে হাসতে। গ্রামের বাজারে চায়ের স্টলে উচ্চকিত শব্দে হাসতে হাসতে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন নানা। দেখতেও খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন, উঁচু লম্বা আর ফর্সা। সম্ভবত বিলেতি মেমরাও নানার প্রেমে পড়েও থাকবেন। আমাদের অ্যালবামে এখনো একজন বিলেতিমেমের ছবি রয়েছে। নানা বেশ কয়েক বছর লন্ডন ছিলেন। ছেলেমেয়ে আর দেশের টানে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি বিভূঁইয়ে। যাই হোক, নানার ডাকে এক সময় ভয়ে ভয়েই উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অমনি অদ্ভুত এক আনন্দের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে লাগলাম। নানা দু’হাত আগলে একের পর এক টাগৈর ওঠান ওপরে আর সে টাগৈর-এর নিচের ঝট থেকে লুফে নিতে থাকেন একের পর এক বড় বড় কই মাছ। টাগৈর ওঠান আর কই মাছে ভরে যেতে থাকে খালৈই। সেদিন খালৈ ভর্তি করে কই মাছ নিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলাম নানানাতি। কই মাছের কাটাও বিঁধেছিল আমার কোমল হাতে। রক্ত বের হয়ে এসেছিল আঙুল থেকে। মনে আছে দূব্বাঘাস লাগিয়ে দিয়েছিলাম সেই রক্তঝরায়।
গ্রামজীবনের একটা ভয়াবহ দিক হলো, শরিকের ঈর্ষা কিংবা হিংসেমিপনা। যেটার বিস্বাদ আমি তীব্রভাবেই পেয়েছিলাম দাদাবাড়িতে। আম পাড়তে গিয়ে, কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে কিংবা ছোটখাটো নানা ব্যাপার নিয়েই শরিকদের সঙ্গে লেগে যেত ঝগড়া। সে এমন মাত-কর ঝগড়া যে, শুধু মুখে মুখেই বয়ে যেত চাইত না ঝড়, শারীরিক আঘাতেও হয়ে উঠত সাইক্লোন। আমার শিশুমনের ওপর যার নিদারুণ বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। নানাবাড়িতে এই মাছধরাকে কেন্দ্র করে টের পেলাম শরিকদের মধ্যে রেষারেষির আরেক রূপ। নানাদের কেউ যদি পুকুরে জাল ফেলতো, সঙ্গে সঙ্গে আরেক শরিকরাও নেমে যেত পুকুরে। কারণ, পুকুরটা যে ছিল চার শরিকের! দুই শরিক গ্রামের বাড়িতে তালা মেরে বাস গেড়েছিল শহরে। এই যে কিছু মানুষের শহরে গিয়ে বসত গড়া, তার পিছনে যে শুধু হঠাৎ ধনী হয়ে উঠাটাই কারণ ছিল, তা নয়, তখন ডাকাতেরও ভীষণ উপদ্রুব ছিল। একটু টাকাপয়সা ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছো তো, চোখ পড়ে গেল তোমার বাড়িতে। তাও আবার কি! ডাকাতরা রীতিমতো চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতো। একবার আমার নানার কাছেও এসেছিল ডাকাতের চিঠি। নানা লাইসেন্স করে একটা বন্দুক আনিয়ে নিয়েছিলেন বাড়িতে। সেটা নিয়ে সকালবিকাল বক শিকার করতে বেরোতেন! শেষ পর্যন্ত ডাকাত আর আসেনি। সেটা কি ওই বন্দুকের ভয়ে নাকি অন্য কোনো কারণে তা বলতে পারব না। তবে কাসেম আলী ব্যাপারীর বাড়িতে চিঠি দিয়েই ডাকাত এসেছিল। আর, ঘটিয়েছিল চরম বিয়োগান্তক ঘটনা। বহু চেষ্টা আর সাধ্য সাধনার পর কাসেম আলী ব্যাপারীর একটা ছেলে হয়েছিল। বয়স হয়েছিল কত! ছয় কী সাত! বাড়িতে ডাকাত পড়ার পর কাসেম আলী ব্যাপারী ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্ধকারে একটা গুলি এসে এফোড় ওফোড় করে দেয় ছেলের পেট! বাবার কোলের মাঝেই মৃত্যু ঘটে সন্তানের। মুখে ইয়া লম্বা দাড়িঅলা হাসিখুশি মানুষটার মুখ থেকে সেই যে হাসি মরে গেল, জীবনে আর কখনো সে মুখে হাসি দেখিনি। তো, আমি বলছিলাম আসলে শরিকদের কথা!, যে শরিক গ্রামে থাকতেন, সেই শরিকদের সঙ্গে মাছ মারার সময় এক ধরনের শীতল যুদ্ধ চলত যেন, যেমন বরফযুদ্ধ ছিল রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে, রেষারেষি ছিল আবহানী আর মোহামেডানের মধ্যে, ঠিক তেমনই। তুমি জালে ভেটকি পেয়েছ তো আমাকে পেতে হবে গরমা। তোমার খালৈয়ে অর্ধেক মাছ তো আমার খালৈইটা হওয়া চাই কানায় কানায় ভর্তি। মাঝখান থেকে কোপটা গিয়ে পড়ত পুকুরের মাছদের ওপর!

চলবে...