অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৬

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি  
বড়শির বাইরে মাছ ধরতে গিয়ে একবার যে আমি কত বড় বিপদে পড়েছিলাম, তা মনে পড়লে আজও আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এক বর্ষায় পানি কেবল গ্রামে ঢুকেছে, ঠেলেঠুলে নানাবাড়ির ঘাটে নৌকা থেকে মাত্র নেমেছি, কোথা থেকে দৌড়ে এলো অরুণ। রাজাবাড়ি স্টাইলে যার নাম অরুইনা। শ্রীকান্তের যেমন ইন্দ্রনাথ আমার তেমন অরুইণা। সেই যে আমার দুঃসাহসী চাচাতো মামা নাসিমের কথা বলছিলাম, তারই ছোট ভাই। তখনকার সমাজের রেওয়াজ অনুযায়ী তারাও বেশ কয়েকজন ভাইবোন ছিল। তখন আজকের মতো এত আয়-রোজগারের পথ খোলা ছিল না। তবু একটি পরিবার সন্তানের পর সন্তান নিত, প্রায় প্রতি বছরই চলতো উৎপাদনের এ ধারা। সমাজও ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখত। নেগেটিভ কোনও ইমপ্যাক্ট ছিল না। নাসিম মামাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন ঝর্ণা খালাম্মা, তারপর চান্দি খালাম্মা, তারপর নাসিম মামা, তারপর লিলি খালাম্মা, তারপর কালা মামা, তারপর নেলি মামা, তারপর পপি ওরফে পঁপঁ। তারপরই অরুণ, আমার পিঠাপিঠি। অরুণের পর কিন্তু আরও দুজন আছে, পাশা, পাশার পরেরটার নাম কী, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, কত আর মনে রাখা যায়?
আমি নানাবাড়ি গেলেই অরুণ অটোমেটিক জুটে যেত আমার সঙ্গে। কোথা থেকে পই পই করে এসে হাজির হতো। এক হাতে সামলাত হাফ প্যান্ট, আরেক হাতে নাকের হিনৎ। বিচিত্র কারণে ওর হাফপ্যান্ট সব সময়ই ঢিলা থাকত। আর সর্দিও যেন ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার সঙ্গে এসে অরুণ এটা খেলত সেটা খেলত, বিশেষ করে মার্বেল আর খাপ। তখন এ দুটো খেলারই ভয়াবহ নেশা ছিল আমার। দুনিয়া যে রঙময় এ দুটো খেলা থেকেই যেন বুঝতে পেরেছিলাম। কত রঙের আর নিখুঁত ফিনিশিংয়েরই না মার্বেল পাওয়া যেত তখন। বিশুদ্ধ সেই বর্ণিলতা যে শুধু প্রকৃতিরাজ্য থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে, তা না, মানুষের হাতের তৈরি সামগ্রীও আজ হারিয়ে ফেলছে হৃদয়ের রঙ। মার্বেল এখন যাচ্ছেতাইভাবে তৈরি হয়। খেলাটাও বোধ হয় প্রায় উঠে গেছে। বাচ্চারা কি এখন ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু খেলে? মোবাইলে গেম খেলারও এখন ব্যাপক চল। মার্বেলের রঙে যেমন আগের সেই বৈচিত্র্যের বিন্যাস নেই, গড়নও হচ্ছে এবড়ো থেবড়ো, যাচ্ছেতাই। সেই হাফ প্যান্ট পরা দিনই তো নেই।
খাপ খেলা হতো সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে। সেজন্য আমরা সব সময়ই ব্যস্ত থাকতাম সিগারেটের খাপ টুকানো নিয়ে। রাস্তাঘাটে যেখানে খাপ পড়ে থাকত, টুকিয়ে নিজের কাছে রাখতাম। দাদাবাড়িতে খাপ টুকানোর জন্য হাটের পর দিন দৌড়ে দৌড়ে চলে যেতাম কাশিমপুর বাজার। সোমবার হাট বসত। হাট মানে সেকি হাট! বিশ বাইশ গ্রামের মানুষ এসে কেনাকাটায় জড়ো হতো সেখানে। ধুমিয়ে খাওয়া হতো সিগরেট! দরদাম নিয়ে ব্যাপারিদের মাথা সবসময়ই গরম থাকত। আর মাথা ঠাণ্ডা রাখার ওষুধ বলতে তো ছিল অই সিগারেটই! আমরা পরদিন সিগারেটের সে প্যাকেট কুড়িয়ে কুড়িয়ে শেষ করতে পারতাম না। নানাবাড়িতে কখনো বাজারে যাইনি অমন কাণ্ড করতে। রাজাবাড়ি হাট বসত বৃহস্পতিবার। কাশিমপুরের মতো ততবেশি জমত না। বোধ হয় আশেপাশের আরো কোনও গ্রামেও হাট বসত। বাজার বসানো নিয়ে গ্রামের সঙ্গে গ্রামের গণ্ডগোল হওয়ার কথা বেশ কয়েকবারই শুনেছি। সেই বিতণ্ডার জেরে অনেক গ্রামের মানুষ নানাবাড়ির হাটে আসত না।  
বিলুপ্ত হওয়া কয়েকটা সিগারেটের প্যাকেটের নাম এখনো মনে আছে- ক্যাপ্সটেন, বৃস্টল, কেটু, রমনা, স্টার। স্টার এখনও আছে। আরও যেন কী কী ছিল। প্যাকের ডিজাইন, রঙ, টাইপোগ্রাফি সবই যে শুধু চোখ কাড়ত, তা না, মনও কেড়ে নিত সমানভাবে। কেটুর গায়ের তুষার স্রোত পাহাড় ভ্রমণের হাতছানি দিয়ে যেত। কেটু নামের বোধহয় একটা স্নোও ছিল। এটা শীতে একচেটিয়া ব্যবহার হতো। সম্ভবত তিব্বত কোম্পানির। ফাইভ ফিফটি ফাইভকে বলা হতো দুতলা সিগারেট। গ্রামে সেভাবে পাওয়া যেত না। ওটা ছিল শহরের আর বড়লোকের সিগারেট। গ্রামে যদি শহরের কোনও সিগারেটখোর বড়লোক আসত বা গ্রামের কেউ শহর থেকে কিনে নিয়ে যেত, তখনই কেবল ফাইভ ফিফটি ফাইভ দেখার সুযোগ মিলতো। তবে ওটার যে সাইজ, তা আমরা অন্য খাপের সঙ্গে মিলিয়ে হাতে রাখতে পারতাম না। তাই সবচেয়ে দামি সিগারেট হলেও আমাদের কাছে ছিল একেবারেই মূল্যহীন।
অরুণের সঙ্গে যে শুধু মার্বেল আর খাপই খেলতাম, তা না। ও আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেত বাজারসহ এদিক সেদিক, এ গ্রামে সে গ্রামে। একদিন সন্ধ্যায় নিয়ে গিয়েছিল ধলেশ্বরীর পাড়। সে স্মৃতি মনে হয় মন থেকে কোনোদিন মোছবার নয়। আমাদের নানাবাড়ি থেকে ধলেশ্বরী নদী দেখা যেত না ঠিক, তবে ধলেশ্বরী নদীতে ছুটে যাওয়া নৌকোর পালগুলো চোখে পড়তো। কত বড় বড় যে পাল থাকত নৌকায়, নানা রঙের! সেসব ছুটে যাওয়া পাল দেখে মনে হতো ধলেশ্বরী নদীতে যেন জীবনের উৎসব বয়ে চলেছে। আমি একদিন অরুণকে ধরেছিলাম চলো যাই নৌকার পালগুলো দেখে আসি। অরুণ আমাকে নিতে পারেনি সেদিন। তবে নিয়েছিল এক জোছনাগলা হালকা হালকা শীতের রাতে। জোছনার আলোছায়ায় কখনো সোজা পথ দিয়ে কখনো বা গ্রামের কোনো বাড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক সময় পৌঁছে গিয়েছিলাম ধলেশ্বরী নদী পাড়। পুরো নদী জোছনায় সাদা হয়েছিল। নৌকার পালগুলো রাতে রঙ হারালেও জোছনা ধারণ করে কী এক অপার্থিব মায়া ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল দূর থেকে দূরে।
তো, আমার এমন শুভাকাংখী বন্ধু কাম ছোটমামা অরুণ এবার আমাকে দেখামাত্রই ছুটে এসে বললো, চলো দাউন দিয়ে মাছ মারব।
শুনে তো আমি মহা উত্তেজিত। পরক্ষণেই ও বলল, বড়শি কিনতে, সূতলি কিনতে তো টাকা লাগবে। তোমার কাছে টাকা আছে? আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা এক মৌল-কিশোর। প্যান্টের পকেটই তো নাই, টাকা থাকে কী করে! ও আমাকে ভজাল, তোমার মায়ের কাছ থেকে নাও। মাছ মারার উদগ্র আগ্রহের কাছে আমার সমস্ত সংকোচ পিছুটানের পরাজয় ঘটলো। আমি আমার মায়ের কাছ থেকে কেঁদেকেটে বুঝি চল্লিশ নাকি পঞ্চাশ টাকা আদায় করতে পেরেছিলাম। ব্যস, অমনি মামাভাগ্নে ছুটে গেলাম বাজারে। বড় ছোট নানা পদের বড়শি কিনে এনে অরুণের সঙ্গে নেমে পড়লাম নানাবাড়ির বাইরের ডুবে থাকা জমিটায়। যেখানে মাত্র এক সপ্তাহ হলো বর্ষার পানি এসে জমা হতে শুরু করেছে। আর দু’তিনদিনের মধ্যে এখানে কোমর পানি হবে, তখন আর নামা যাবে না। মনে হবে গভীর সাগরের অংশ। আমি আর অরুণ নানাদের জমিটা পার হয়ে, যেখানে অন্য জমি আর নানাদের জমির মাঝখান দিয়ে লম্বা এক আইল চলে গেছে, সে আইলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নির্দিষ্ট একটি দূরত্বে দূরত্বে কঞ্চি গেঁথে, সে কঞ্চিতে কঞ্চিতে লম্বা সূতলি বেঁধে দিলাম। অল্প কিছু দূরত্ব রেখে রেখে সূতোয় বাঁধা বড়শিগুলো পানির ভেতরে ফেলে রাখলাম। অরুণতো নাসিম মামারই ভাই। যেমন সাহসী তেমনি ঘেন্নাটেন্নাও কম।
কোথা থেকে কেঁচো নিয়ে এসে আধার হিসেবে প্রতিটি বড়শির মধ্যে গেঁথে দিয়েছিল। তারপর বললো, চলো মামা। এখন যাই। আবার বিকালে আসব।
দুপুরবেলা খাওয়া শেষ করে কেবল নানার বেডে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি, তখনই কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো অরুণ। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল গেটের বাইরে। তারপর পানিতে নামতে নামতে যেখানে দাউন দিয়েছি, সেদিকে যেতে যেতে বললো, মনে হয় বড় কোনো মাছ ধরেছে, একটা বড়শি খুব নড়ছে। চলো বড়শিগুলা খুঁজে দেখি। অরুণ মামা আমাকে পাঠিয়ে দেয় একদিকে আর নিজে যায় আরেকদিকে। আমি সত্যি সত্যি খেয়াল করলাম একটা বড়শি যেন নড়ছে। পানির নিচে হাত দিয়ে ভীষণ উত্তেজনা বোধ করি, সত্যিই তো কিছু একটা ধরেছে আমার বড়শিতে। বেশ বড়সড় লম্বা। কী এটা? বাইনমাছ? পানি থেকে উঁচিয়ে ধরেই ভয়ে আতংকে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার হাতের মধ্যে ধরা রয়েছে ছোটখাটো একটা লম্বা সাপ। বেশ লম্বা সাপ, তবে মৃত! আমার ভয় আর চিৎকার দেখে হো হো অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো অরুণ। ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে হাত থেকে সাপটা নিজের হাতে নিয়ে বলতে লাগলো, ভয় পাইছো মামা?
তারপর কি আর দাউন দিয়ে মাছ মারার শখ থাকে? আমি আর ওমুখো কোনদিন হইনি। অনেক বছর পর অরুণমামা স্বীকার করেছিল যে, কা-টা ওরই। একটা দোরা সাপ মেরে ও-ই বঁড়শির মধ্যে গেঁথে রেখেছিল। কেনো, তা কি আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে? এক চান্সে অরুণ মামা নিজের জন্য নিয়মিত দাউন ফেলে মাছ মারার ব্যবস্থা করেছিল। নানানানির কাছ থেকে একসঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা আদায় করা ওর পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না।

চলবে...