আর্ট অব ফিকশন: উমবের্তো একো

অনুবাদ: এমদাদ রহমান

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০১৮

উমবার্তো একো একজন ইতালীয় সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক এবং সংকেত বিশ্লেষক। জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৩২, মৃত্যু ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। তার রচিত ‘দ্য নেম অব দ্য রোজ’ ২০১৩ সালের ইউরোপের সর্বাধিক বিক্রিত বই। এ বইটির মাধ্যমে রহস্যতত্ত্ব ও গূঢ়তত্ত্বের উপস্থাপনা করা হয়েছে। একে প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের মধ্যে একটা দার্শনিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফুকো`জ পেন্ডুলাম’। যেসব জিনিস বৈজ্ঞানিকভাবে ভূল প্রমাণিত হয়েছে, যেমন জাদুবিদ্যা, আলকেমি ইত্যাদিতে তার আগ্রহ ছিল বেশি।

 

সাক্ষাৎকারী: দিনের কোন সময়টায় লেখেন?
উমবের্তো একো: আমার এমন কোনও নিয়ম নেই। আর, আমার জন্য কোনও একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে নিয়ে লিখতে বসাটা সত্যিই অসম্ভব। লেখা হয়তো এমন হয়েছে যে, আমি সকাল সাতটার দিকে লিখতে শুরু করলাম, আর শেষ করলাম রাত তিনটার দিকে। একটা স্যান্ডউইচ খেতে খেতে দিনটা শেষ হলো। মাঝে মাঝে আমি লেখার কোনও প্রয়োজনই বোধ করি না।

সাক্ষাৎকারী: যখন লেখেন, ঠিক কতক্ষণ লেখেন প্রতিদিন? এখানেও কি কোনও নিয়ম মেনে চলেন না?
উমবের্তো একো: না। শোনেন, লেখালেখির মানে কিন্তু এটা নয় যে, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে একটা কাগজে কিছু লিখে ফেললাম। আপনি কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে কিংবা কিছু খেতে খেতেও একটা পরিচ্ছেদ লিখে ফেলতে পারেন।

সাক্ষাৎকারী: সুতরাং, আপনার জন্য প্রতিটি দিনই ভিন্নরকমের অভিজ্ঞতা?
উমবের্তো একো: আমি যদি গ্রামের বাড়িটিতে থাকি, মন্ট্রেফেলট্রয়`র পাহাড়চূড়ার সেই বাড়ি, তখন অবশ্য লেখা নিয়ে আমার একটা রুটিন থাকে। আমি কম্পিউটারটা চালু করি, ই-মেইলগুলি দেখি, কিছু পড়তে শুরু করি, এবং তারপর বিকেল পর্যন্ত লিখি। তারপর গ্রামের রাস্তায় ঘুরতে বের হই, সেখানে, পানশালায় গিয়ে একটা গ্লাস নিয়ে পত্রিকা পড়ি। তারপর ঘরে ফিরে টেলিভিশন কিংবা ডিভিডি দেখি সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা অব্দি। দেখা শেষ হলে একটু লেখালেখি করি রাত একটা থেকে দুটো পর্যন্ত। এখানে আমার দৈনন্দিন রুটিনটা এরকমই থাকে, কারণ এখানে কাজে বিঘ্ন তৈরি করার কিছু নেই। কিন্তু আমি যখন মিলানে থাকি, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন কিন্তু আমি আমার নিজের সময়ের উপর আর কর্তৃত্ব করতে পারি না। এখানে সবসময় একজন না একজন সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, আমি কখন কী কাজ করব।

সাক্ষাৎকারী: লিখতে যখন বসেন, তখন কোনোরকম উদ্বেগ কিংবা দুশ্চিন্তায় ভোগেন?
উমবের্তো একো: না, আমার কোনও উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেই।

সাক্ষাৎকারী: দুশ্চিন্তা কিম্বা উদ্বেগ কিছুই নেই, একথা জেনে আশ্চর্য হলাম!
উমবের্তো একো: লিখতে বসার আগে আমি গভীর আনন্দে থাকি।

সাক্ষাৎকারী: আপনার কাছে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার কী?
উমবের্তো একো: রাত হলেই উপন্যাস পড়া। মাঝেমাঝে আমি অবাক হই এই ভেবে যে, একজন ধর্মভ্রষ্ট ক্যাথলিক হিসেবে আমার মগজে একবারও ফিসফিস করে বাঁশি বাজে না এই বলে যে, উপন্যাসকে দিনের আলোয় পড়তে হবে, আর ব্যাপারটা বড়ই আনন্দদায়ক। সুতরাং দিন হলো প্রবন্ধ এবং অন্যান্য কঠিন কাজগুলি করার জন্য।

সাক্ষাৎকারী: আপনার উপন্যাসগুলি ঠিক কোন কারণে আত্মজীবনীমূলক?
উমবের্তো একো: কয়েকটি বিশেষ কারণে, আমি মনে করি যে প্রতিটি উপন্যাসই তাই। আপনি যখন একটি চরিত্রকে কল্পনা করছেন, তখন কিন্তু আপনি তাকে গড়ছেন, চরিত্রটি নারী কি পুরুষ যা-ই হোক, আপনি কিন্তু তাকে গড়ে তুলছেন। কিন্তু তাকে আপনি গড়ছেন আপনার একান্ত কিছু স্মৃতির সাহায্যে। আপনি আপনার নিজের একটি অংশকে দিচ্ছেন প্রথম চরিত্রটিকে, অন্য অংশটিকে দিচ্ছেন দ্বিতীয় চরিত্রটিকে। এই অর্থেই বলছি, আমি কিন্তু শুধু একটি আত্মস্মৃতি লিখছি না, তবে উপন্যাসগুলি হচ্ছে আমার আত্মজীবনী। ব্যাবধানটা এখানেই।

সাক্ষাৎকারী: আপনার সমকালীন উপন্যাসগুলি পড়ার মতো সময় আপনার আছে কি?
উমবের্তো একো: না। সময় তেমন একটা নেই। যখন থেকে আমি উপন্যাসিক হলাম, বুঝতে পারলাম যে, আমি যেন একটা বিশেষ দিকে ঝুঁকছি কিংবা কেউ আমার উপর ভর করছে। তাছাড়া এই সময়ের একটি উপন্যাস যদি আমার উপন্যাসের চেয়ে খারাপ হয়, তাহলে সেটা আমার ভালোই লাগবে না; কিংবা আমার এরকম একটি সংশয় থাকে যে, উপন্যাসটি যদি আমার চেয়েও ভাল হয় তখনও আমি তাকে পছন্দ করতে পারব না।

সাক্ষাৎকারী: প্রভাবিত করতে পেয়েছেন, এমন কেউ আছেন?
উমবের্তো একো: জয়েস আর বোর্হেসই প্রভাব রেখেছেন বেশি; যদিও কথাটা সম্পূর্ণরূপে সত্য নয়। আসলে সবাই। প্রত্যেকেই আমাকে প্রভাবিত করেছেন। জয়েস, বোর্হেস তো সুনিশ্চিতভাবে। কিন্তু তারাও- অ্যারিস্টটল, থমাস একুইনাস, জন লুক।

সাক্ষাৎকারী: জীবনের এই পর্যায়ে, কোনও কিছু নিয়ে কোন আক্ষেপ কিংবা অনুতাপ কী আছে?
উমবের্তো একো: সবকিছু নিয়েই আমার দুঃখ, আমার খেদ আছে। কারণ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই আমি অজস্র ভুল করেছি। তবে যদি আবারও এই জীবনটাকে প্রথম থেকে শুরু করা যেত, অকপটে স্বীকার করছি, তখনও কিন্তু সেই একটি ভুল করব। পুরো জীবনটাকেই আমি ব্যয় করেছি আমার স্বভাবটাকে, আচরণটাকে বুঝতে গিয়ে, আমার ধারণাগুলিকে পরীক্ষা করতে করতে; আর আত্মসমালোচনা করেছি সব সময়। আমি এমন এক কঠিন মানুষ যে, নিজেকে বিপন্ন করে ফেলা আত্মসমালোচনার ব্যাপারে আপনাকে কিছুই বলব না, এমনকি, মিলিয়ন ডলারের বিনিময়েও নয়।

সাক্ষাতকারী: কে আপনাকে লেখালেখিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন?
উমবের্তো একো: আমার মায়ের মা। তিনি ছিলেন একজন নাছোড়বান্দা পাঠক। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও যিনি পড়তেন। এলিমেন্টারি স্কুলের মাত্র পাঁচটি ধাপ কোনোরকমে পার হতে পেরেছিলেন তো কী হয়েছে, এরই মধ্যে তিনি মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে গিয়েছিলেন। সেই লাইব্রেরি থেকে সপ্তায় দুই থেকে তিনখানা বই তিনি আমার জন্যই আনতেন। বইগুলি হতো দশ পয়সা দামের উপন্যাস, কিংবা বালজাক। তার দৃষ্টিতে, এসবের মধ্যে তেমন বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই, সবগুলি উপন্যাসই চিত্ত-আকর্ষক। আর একজন হলেন আমার মা, ভবিষ্যতে যিনি আঙুলের ছাপের পাঠোদ্ধারের কাজ করবেন, পড়তে শুরু করেছিলেন ফরাসি আর জর্মন, এবং যদিও তারুণ্যে প্রচুর বই পড়েছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও আলস্যের বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন, পড়তে শুরু করেছিলেন রোমান্স উপন্যাস আর নারীদের ম্যাগাজিন। সুতরাং আমি তা পছন্দ করতাম না যা তিনি পড়তেন। তিনি সহজ মাধুর্যময় কথা বলতেন ইতালিয়ান কেতায়, হাতের লেখা এত সুন্দর ছিল যে, তার বন্ধুরা তাকে তাদের চিঠিগুলি লিখে দিতে বলতেন। ভাষার প্রতি তার এক গভীর সংবেদনশীলতা ছিল, যদিও খুব অল্প বয়সেই তিনি স্কুল ছেড়ে ছিলেন। আমি মনে করি, লেখালেখির জন্য আমি তার কাছ থেকেই সৃজনী-সংরাগের উত্তাপটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, আর পেয়েছি আমার লিখনশৈলীর প্রাথমিক উপকরণগুলি।

‘প্যারিস রিভিউ’ এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে বাঙ্লায়ন এমদাদ রহমান