আল মাহমুদের অন্তর্ভেদী চোখ

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯

অদ্ভূত-বিচিত্র এক ক্যারেক্টার এই আমাদের পিয়ারু ভাই। ইশকুলের আট ক্লাস পর্যন্ত পড়ে ফেরার হয়ে কলকাতা-চিটাগং ঘুরে সেই যে ঢাকায় এসেছিলেন পঞ্চাশের দশকে— তারপর আর কোনোদিন বাউনবাড়িয়া ফেরা হয়নি তার। প্রত্যাবর্তনের লজ্জা নিয়ে তিনি আর কেনোদিন মুখোমুখি হননি তার আম্মার। আমৃত্যু ঢাকাতেই ছিলেন, বলতেন, ‘অন্নদাত্রী ঢাকা’। ঢাকা তাকে অন্নের যোগান দিয়েছিল বটে, তবে… থাক সেসব কথা।

পিয়ারু ভাই ঢাকা এসেছিলেন একটি ট্রাঙ্ক সঙ্গে করে। সবাই বলে, ট্রাঙ্কের ভেতর করে তিনি আসলে বাংলার নদী, গ্রামীণ জনপদ, লোকজ শব্দ আর পুরাণ মিথ নিয়ে এসেছিলেন। বাংলাসাহিত্যের বেদিমূলে সেসব নৈবেদ্য তুলে দিয়ে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন ‘সোনালি কাবিনের কবি’ হিসেবে। কিন্তু বড় বিস্ময়জাগানিয়া হলেও সত্য, তিনি আমার কাছে পরিচিত ‘জলবেশ্যা’র গল্পকার হিসেবে। কারণটা খুলে বলি।

তখন শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে পরিণত হবার কাল পাড়ি দিচ্ছি। মাত্রই কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের বারান্দায় পা রেখেছি। পা রেখেছি সাহিত্যের গলি-ঘুপচিতেও। যে গলিতে সাহিত্যের অমূল্য সম্ভারের সন্ধান পেয়েছিলাম সেইকালে, সেই গলিটার অবশ্য নাম নেই। আমরা বলতাম, আকবরিয়ার পাশের গলি। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলের পাশের সেই ছোট্ট চিকন গলিটা!

গলিটার ভেতরে দু’তিনটি পুরনো বইয়ের দোকান ছিল। সেখানেই একদিন করতলগত হয়েছিল ‘বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প’ নামের একটি বই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত। সেই বইয়েই পড়েছিলাম জলবেশ্যা গল্পটি। তখনো সোনালি কাবিন পড়া হয়নি আমার। পড়া হয়নি আল মাহমুদের অন্য কোনোকিছুই।

তাই পয়লাপাঠেই ‘জলবেশ্যা’ মাথায় গেঁথে গেল বর্শার ফলার মতো। গেঁথে গেল তো গেলই, বের হলো না আজও। পরবর্তীতে সোনালি কাবিন থেকে শুরু করে আল মাহমুদসমগ্র পড়া হয়েছে, কিন্তু জলবেশ্যার ঘোর থেকে বের হতে পারিনি। সে কারণে আল মাহমুদ আমার কাছে জলবেশ্যার গল্পকার।

দিনকয়েক আগে তিনি দেহ রাখলেন। আমার তো মনে হয় তিনি তিরিশ বছর আগেই মারা গেছেন। গত শুক্রবার দিনগত রাতে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। আর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত পুনর্জন্ম লাভ করলেন। তিন দশক বছর ধরে মৃত আল মাহমুদ এখন জীবনানন্দের মতো ফিরে আসবেন এই ভূ-বাংলায়, সন্দেহ নেই। তিনি বহুল পঠিত হবেন। হবেনই। তাঁর বিদায়ক্ষণে এইসব মনে পড়ছে। আর মনে পড়ছে জলবেশ্যার কথা।

জলবেশ্যা এমনই এক গল্প যেখানে তিনি বেহুলা-লখিন্দরের সনাতন মিথকে ভেঙে ফেলেছেন। গল্পের প্রধান দুই চরিত্র আবিদ বেপারী আর বেদেকন্যা বেউলা সুন্দরী। পুরাণের গল্পে দেখা যায়, লখিন্দরের প্রাণরক্ষার জন্য বেহুলাকে ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে দেবকুলের মনোরঞ্জন করতে হয়েছিল। বেহুলা মূলত তার সতীত্বের মহিমা দিয়ে উজ্জ্বল করেছে ভারতীয় নারীর পরিচয়কে এবং সে কারণে বেহুলা এক শ্রদ্ধেয় চরিত্র হিসেবে কীর্তিত হয়েছে কালে কালে। কিন্তু নব্যকালের বেহুলার কাছে সতীত্বের শাস্ত্রিক মূল্য নেই, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অর্থ। ফলে বহমান নদীর বুকে ভাসমান নৌকায় নতুন টাকার মালিক আবিদ বেপারীর সঙ্গে বেউলা সুন্দরী গড়ে তোলে শরীরী সম্পর্ক। সম্পর্কটি চমৎকার কিন্তু হার্দিক নয়। সম্পর্কটি শুধুই আর্থিক। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সেই সম্পর্কের মধ্যেও ছিল প্রতারণা। বেহুলা লখিন্দরের মিথে দেখা যায়, লোহার বাসরঘরের সামান্য ছিদ্রপথে প্রবেশ করেছিল কালসাপ এবং তা দংশন করেছিল লখিন্দরকে। আর জলবেশ্যায় দেখা যায়, বাসরঘর নয়—নৌকা এবং ছিদ্রপথ নয়—ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসা সাপের কামড়ে প্রাণ দিতে হয় আবিদ বেপারীকে। ঝাঁপির ডালা উন্মোচন করেছিল বেউলা সুন্দরী স্বয়ং। তারপর সাপের ছোবলে অচেতন হয়ে পড়া বেপারীকে নৌকার ওপর ফেলে রেখে বেউলা পা বাড়ায় নতুন ঠিকানা দিকে।

লিবিডোনির্ভর এই গল্পে আল মাহমুদ যে প্রতীক নির্মাণ করেছেন, এমন মেধাবী প্রতীকতার নির্মাণ আমার ছোট্ট পাঠকজীবনে আর কোনো গল্পে দেখিনি। তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার, আলাউদ্দিন আল আজাদ অনেকেই লিখেছেন এই ধারায়। আল মাহমুদ সেই লিবিডোকেই গল্পে প্রধান করে তুলেছেন কিন্তু এই রূপায়ণটি অথ্যন্ত মেধাবী এবং প্রতীকমনস্ক। ভারতীয় এবং সেমিটিক মিথের অনুষঙ্গে তাঁর গল্পের পরিপ্রেক্ষিত উজ্জ্বল ও বর্ণাঢ্য।

বলে রাখা ভালো, কবির বেশিরভাগ গল্পই অবশ্য লিবিডোনির্ভর। তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পগুলো আলো ফেলছিল পুরান ঢাকার কুট্টিজীবনে, হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলো আলো ফেলছিল দেশভাগের যাতনার ওপর, আবদুশ শাকুর লিখে যাচ্ছিলেন ব্যঙ্গভাষায় নগরগাথা আর আল মাহমুদের অন্তর্ভেদী চোখ গিয়ে পড়েছিল নারী-পুরুষের যৌনমনস্তত্বের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ, ট্যাবুযুক্ত এক বিষয়কেই তিনি গল্পের আরাধ্য করেছিলেন। যে জীবনকে আমরা ঢেকে রাখি মানবীয় ভব্যতা দিয়ে সেই জীবনের অন্ধিসন্ধিতেই বিচরণ করেছেন তিনি। পানকৌড়ির রক্ত, কালো নৌকা, ঈভের ছায়া—এসব গল্পের পরতে পরতে দেখতে পাই সেই লিবিডোরই শৈল্পিক প্রকাশ।

তার গল্পগুলো সরল পথে চলে না। বর্ণনাভঙ্গি একরৈখিক নয়। দুই-চার-দশ লাইন গল্প বলার পরই তিনি পেছনে হাঁটেন। গল্পের অন্তরালের গল্প বলেন। তারপর আবার ফিরে আসেন বর্তমানে। খানিক বর্তমানে বিচরণের পর ফের হাঁটা দেন পশ্চাতে। কখনো কখনো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায় তাঁর গল্পে। ম্যাজিক রিয়েলিজম? পানকৌড়ির রক্ত থেকে উদাহরণ খোঁজা যাক:

‘নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে আমি সেখানে এসে পেশাদার শিকারির মতো হাঁটু গেড়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম, আমার বসার সাথে সাথে কালো বেলুনের মতো একটা পানকৌড়ি পানির ওপর ভেসে উঠল। আমি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে গুলি ছুঁড়লাম। গুলির শব্দ আর বন্দুকের পাল্টা ধকলে আমার চোখের সামনে সমগ্র নিসর্গচিত্রটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আমি দেখলাম, একটি শ্যামবর্ণ নারীশরীর নদীর নীলিমায় আপন রক্তের মধ্যে তোলপাড় করছে।’

গল্পের নায়ক শিকার করলেন একটি পানকৌড়িকে, কিন্তু গুলিবিদ্ধ পানকৌড়ি যখন পানিতে লুটিয়ে পড়ল তখন তিনি দেখতে পেলেন একটি শ্যামবর্ণ নারীশরীর রক্তের মধ্যে তোলপাড় করছে! পানকৌড়ি কী করে একটি শ্যামবর্ণ নারীশরীর হয়ে যায়? এর নামই কি জাদুবাস্তবতা? থাক সে বিতর্ক।

তার ভাষার দিকে নজর ফেরালে দেখা যায়, অসম্ভব শক্তিশালী মায়াবী এক ভাষা ছিল তার করায়ত্ব। সেই ভাষায় ছিল এমন এক যাদু যা সহজেই পাঠককে মোহগ্রস্ত করে ফেলে। প্রতীক আর উপমার ব্যবহারে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তার তুলনা বিরল। এমন ভাষার কাছে বারংবার নতজানু হতে ইচ্ছে করে। যদি আর কিছুই না লিখতেন, শুধু পানকৌড়ির রক্ত আর জলবেশ্যার জন্যই তিনি বাংলাসাহিত্যে অমর হয়ে থাকতে পারতেন।

তারপরও… হায়! সত্তুরের পর ক্যান যে লিখতে গেলেন! বড় অদ্ভূত-বিচিত্র এক ক্যারেক্টার আমাদের এই পিয়ারু ভাই।