এক ঝলক মুহম্মদ খসরু

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯

বাংলাদেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মুহম্মদ খসরু ভারতের হুগলী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে। তার বাবা হুগলী জুট মিলের কর্মকর্তা ছিলেন, সেই সূত্রে তারা থাকতেন হুগলীতে। কিন্তু সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ৫০ দশ‌কে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। সেই থেকে তিনি ঢাকায়।

দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র আন্দেলনের সাথে জড়িত থাকায় মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আন্দেলনের পুরোধা ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত। তিনি প্রা‌তিষ্ঠা‌নিক বিদ্যার বাইরে নি‌জেকে গ‌ড়ে তোলেন নিজের ইচ্ছামতো। কখনো লেখক হিসেবে, কখনো সম্পাদক হিসেবে, কখনো সংগঠক হিসেবে। জীবনের বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে কাটালেও নিভৃতচারী স্বভাবের এ মানুষটি মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার পৈত্রিকনিবাস কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে বসবাস করেন।

মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্র বিষয়ক কালজয়ী পত্রিকা ‘ধ্রুপদী’র সম্পাদক হিসেবে চলচ্চিত্র মহলে খ্যাতিমান। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এই পথিকৃত প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম স্টাডি সেন্টার। মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক হিসাবেও কাজ করেন।

মুহম্মদ খসরু সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ফিল্মফ্রিতে লেখেন, “মুহম্মদ খসরুকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা জানেন যে, মানুষ হিসেবে তিনি ক্ষেপাটে, রাগী, মুখে তার অবিরাম খিস্তি। তার সব রাগ, ক্ষোভ ঐ চলচ্চিত্রকে ঘিরেই, এই মানুষ বেঁচে আছেন সংসার করবার জন্য নয়, সম্পদ অর্জনের জন্য নয়, খ্যাতি কুড়াবার জন্য নয়, শুধুমাত্র একটি শিল্পমাধ্যমকে ভালোবাসবার এবং সে ভালোবাসা অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্য।”

১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে যে উদ্যোক্তারা তাদের মধ্যে মুহম্মদ খসরু অন্যতম। সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র প্রদর্শন আয়োজন করা, সেসব চলচ্চিত্র পঠন পাঠনের মাধ্যমে আস্বাদন-অনুধাবন-উপলব্ধি করা, সেগুলো নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা করা, চলচ্চিত্র-বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার, সর্বোপরি সমঝদার ও রুচিবান দর্শক তৈরি করার যে চেষ্টা সূত্রপাত হয়েছিলো ১৯৬৩ সালে মুহম্মদ খসরু সেই ধারাবাহিকতাটাই ধরে রেখেছিলেন গত প্রায় অর্ধশত বছর যাবৎ। সে সময় অর্থাৎ ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ স্থাপনের সময় অনেকেই ছিলেন যার মধ্যে আনোয়ারুল হক খান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, আবদুস সবুর, সালাহ্উদ্দিন ও মুহম্মদ খসরুসহ আরো অনেকেই।

হালকা বি‌নোদ‌নের বাইরে সি‌রিয়াস চল‌চিত্রের প্রতি দর্শক-নির্মাতা‌দের ম‌নো‌যোগ ফিরা‌তে চল‌চ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের যে সূত্রপাত হয়, তার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে চল‌চ্চিত্র সংসদের আদলে মুহম্মদ খসরু ও তার অনুশারীরা প্রায় অর্ধশত বছর ধরে নির্মা‌ণের কা‌রিগ‌রি দক্ষতা বাড়াতে দে‌শের বাই‌রে থে‌কে দক্ষ লোক এনে ওয়ার্কশপের আয়োজন ও দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করে নিয়মিতভাবে।

চলচ্চিত্র নি‌য়ে প‌ত্রপত্রিকায় ক্রিটিক্যাল লেখালেখি ও গবেষণার ধারাবাহিকতা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে, যখন তৎকালীন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরুর সম্পাদিত চলচ্চিত্রের কাগজ ধ্রুপদী প্রকাশের মাধ্যমে, তৎকালিন সময় চলচ্চিত্রের পত্রিকা সম্পাদনা কিংবা প্রকাশ করা ছিলো প্রায় অসম্ভব কাজ, এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে মুহম্মদ খসরুর হাত ধরে, দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতা রক্ষাটাও আরেকটা অসম্ভপর কাজ, সে কাজটাও মুহম্মদ খসরু তার সাধ্যমত চেষ্টা করেন।

মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী মানুষজনকে প্রচুর অনুপ্রেরণা দিতেন, বিভিন্ন চলচ্চিত্রের বিষয়াদি খিস্তিও করতেন। তবুও সিরিয়াস চল‌চ্চিত্রের বিষয়ে আগ্রহী মানুষজন তাকে ঘিরে তৎপর ছিল। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এই প্রবাদতুল্য মানুষটি উৎসাহিত করেছেন দেশের বর্তমান সময়ের খ্যাতনামা অনেক চলচ্চিকারদের যা চলচ্চিত্রকারদের মুখে মুখে কিংবা তাদের লেখায় পাওয়া যায়।

অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের ফেরিঅলা তারেক মাসুদও। এভাবে তিনি তার কর্মময় সময়ে হয়ে উঠেছিলেন যাপনে-চিন্তায় বহু মানুষের প্রেরণা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে চল‌চ্চিত্র সংসদ আন্দোলন থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের মতো কাজ করেছেন, তাদের সবার নিজেদের সেই সিনেমা বানানোর চেষ্টা এখন ‘বিকল্পধারা’ হিসেবে পরিচিত।

লেখক ও গেবেষক সাজেদুল আউয়ালের ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর: অর্জন ও অতৃপ্তি’ শীর্ষক লেখাটি পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় মুহম্মদ খসরু কিভাবে ভাবতেন চলচ্চিত্র নিয়ে।

মুহম্মদ খসরু কয়েকটি বইও লিখেছেন। এগুলো হলো, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়।

মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত পত্রিকাগুলো হলো, ধ্রুপদি, চলচ্চিত্রপত্র, ক্যামেরা যখন রাইফেল, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বিশেষ সংখ্যা, ক্যামেরার পিছনে মুহম্মদ খসরু।

ভারতীয় চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার ১৯৭৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘পালঙ্ক’ ছবিটি নির্মাণের সময় মুহম্মদ খসরু সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তার চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের, হাসান আজিজুল হক রচিত গল্প ‘নামহীন গোত্রহীন’ অবলম্বনে একটি চিত্রনাট্যও তিনি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু কোনো প্রযোজক পাননি। রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য জমাও দিয়েছেন দুই বার, কিন্তু অনুদান মেলেনি।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য মুহম্মদ খসরু হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী পদক’ অর্জন করেন। এছাড়া লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আজীবন সম্মাননা ২০১৭।