একজন কমললেবুর খোসা

বনি আমিন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮

শাহাদুজ্জামানের `ক্রাচের কর্নেল’ পড়তে গিয়ে এবং তার সম্পর্কে আরো তথ্য কালেক্ট করতে শিবুকুমার শীলের সাথে এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জেনেছিলাম, তিনি কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছেন এবং অচিরেই সেটি শেষ হবে। বছর দু`তিন আগেই তাই আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বইটা পড়ার। আমার কর্মস্থল গ্রামে হওয়ায় কিছুটা ব্যাকডেটে খবরাখবর (বইপত্রের) জানতে হয়।

মাসখানেক আগে খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডে আমার বাসার পাশে সৃজনশীল বইয়ের দোকান ‘মৃত্তিকা’তে ঢুকি বন্ধু শঙ্করের সাথে সাতক্ষীরার লেখক জহুরুল আলম সিদ্দিকীর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রর উপরে নব প্রকাশিত বইয়ের খোঁজে। তো সেটার কপি শেষ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য বই দেখতে দেখতে চোখ পড়লো, ‘একজন কমলালেবু’র ওপর। বহুদিন থেকে প্রত্যাশায় থাকা কোনো জিনিস— যে জিনিস আনন্দের, বোধের— তা হঠাৎ পাওয়া গেলে যে আনন্দানুভূতি হয়, আমার মধ্যে তখন সেই আনন্দ।

এর মধ্যে আরেক প্রফেসরের (পাশেই সরকারি পাইওনিয়ার কলেজের) আগমন ঘটলে, সে শঙ্করের একসূত্রে কলিগ হওয়ায় রহস্য করে বলতে থাকে, দাদা, আপনি এখানে! আপনাকে তো কোনোদিন বই-টই কিনতে দেখিনি!

আসলে বই আমরা বাঙালিরা কিনি না বা কেনার অভ্যেস নেই, সে কথাতো বিদগ্ধ পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গেছেন। এই আমি বই একসময় টাকা ধার করেও কিনতাম কিন্তু সংসারের ঘাড়ে পড়লে আর কেনা হয়ে ওঠেনি। ক্রাচের কর্নেল পিডিএফ পেয়ে পড়েছিলাম, এই প্রযুক্তির কল্যাণে যা হোক কিছু বইপত্র পড়া হচ্ছে। কাগুজে বই টাকা দিয়ে কিনে পড়া প্রায়ই আমার হয়ে ওঠে না। তো কী মনে হলো, বইটা নগদ টাকা দিয়ে কিনেই ফেললাম।

আমার ক্রয়কৃত বইটা দ্বিতীয় সংস্করণ জুলাই ২০১৮ তে যেটি হয়েছে এবং প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তে। সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রফেসররা গল্পই করে যাচ্ছেন আর নীরবে `মৃত্তিকা` থেকে ‘একজন কমলালেবু’ কিনে প্যাকেট করছি দেখে তারা বলতে থাকলেন, বেশ ভালো বই, অনেক কিছু জানার আছে।

আমি মনে মনে বলতে থাকি, সাহিত্যের বইতো জানার আছে ‘অনেক কিছু নয়’, সেতো নিছক নির্মল আনন্দ পাওয়ার জন্যে, আমিতো বইটা কিনি সেই আনন্দ পাওয়ার তরে।

শাহাদুজ্জামানের লেখা অনেক পরিশ্রম সঞ্জাত। যে পরিচয় আমি পেয়েছিলাম ক্রাচের কর্নেল পড়তে গিয়ে। জীবনানন্দ দাশ এমন একজন কবি, যার কবিতা দ্বারা পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা বেশি প্রভাবিত। তার কবিতা না বুঝলেও, কেমন একটা ভালো লাগা দোলা দিয়ে যায় প্রকৃত কবিতা পাঠকের মনে। আমি যখন জীবনানন্দের কবিতা দশক আশির শেষ এবং নব্বইয়ের প্রথম দিকে পড়তে শুরু করি তখন সেই ভালো লাগা বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে আরো পরিণত পাঠক হয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-জসীম ত্যাগ করেছিলাম কিন্তু জীবনানন্দের পাঠকে আরো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরতে হয়েছিল। সাহিত্যের ছোট-খাট শিক্ষক হিসেবে আমাকেও পাঠদান করতে হয়।

জীবনানন্দ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদেরকে জানাতে গিয়ে আমি সেদিন বলেই ফেললাম, আজও পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম বা জসীম উদ্দীন বাংলাদেশে যতটা পরিচিত পেয়েছেন, জীবনানন্দ সেভাবে পাননি। ওপার বাংলায় জন্মগ্রহণকারী কাজী সাহেবকে আমরা যেভাবে মর্যদা দিয়েছি, এপার বাঙলায় জন্মগ্রহণকারী বাংলার রূপসৌন্দর্যকে কবিতায় তুলে ধরার জুড়িহীন কবি জীবনানন্দকে আমরা সেভাবে মর্যাদা দিতে পারিনি।

শাহাদুজ্জামান কবি জীবনানন্দের জীবনভিত্তিক যে উপন্যাস লিখেছেন, তা উপন্যাস হয়েছে, নাকি কাব্যালোচনা, না জীবনী হয়েছে সে ত্রিবিধ দ্বন্দ্ব আমার কাটছে না। লেখক তো বলছেন, তিনি উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু উপন্যাসের যে রসোপরিণতি আমার পাঠে আমি সেটা ধরতে পারিনি।

অবশ্যই কবি জীবনানন্দের জীবনের নানান তথ্যসমৃদ্ধ বইটা। এ তথ্যগুলো লেখক হাজির করেছেন কবির ডায়রি থেকে এবং সাপোর্টে রেখেছেন তার কবিতাকে। এই যে তথ্যসমৃদ্ধ জীবনানন্দকে শাহাদুজ্জামান হাজির করলেন আমার বিবেচনায় সেটা ঠিক হয়নি। জীবনানন্দ তার পাঠকের কাছে যে রহস্যময় থাকতেন, সেটাই বরং ভালো ছিল। তা প্রকাশ করে একজন কমলালেবুর খোসাই শাহাদুজ্জামান পাঠককে উপহার দিয়েছেন।

একুশে বইমেলা ২০১৮