একেই বলে উপন্যাসের জনপ্রিয়তা

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮

ঔপন্যাসিক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক ব্যাপকভাবে আলোচিত হন মূলত ‘খেলারাম খেলে যা’র মধ্য দিয়ে। সচিত্র সন্ধানীতে উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এটির বিরুদ্ধে ‘অশ্লীলতার’ অভিযোগ ওঠে। তথাকথিত সেই অশ্লীলতার কথা চাউড় হয়ে যায় পাঠকমহলে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায় পত্রিকাটির সব ক’টি কপি। তখন তরুণ-যুবক পাঠকরা উপন্যাসটি পড়েছে প্রকাশ্যে, তরুণী-যুবতীরা পড়েছে লুকিয়ে। বাবা-মায়েরা পত্রিকাটি তালাবদ্ধ করে রাখেন আলমিরাতে। মায়ের আঁচল থেকে চাবি চুরি করে মেয়েরা সেই পত্রিকায় উপন্যাসটি পড়েছে। প্রায় ৪৭ বছর পরেও উপন্যাসটি এখনো পাঠকের আগ্রহ ধরে রেখেছে। এখনো মুদ্রণের পর মুদ্রণ হচ্ছে, অনাগত দিনেও হতে থাকবে। একেই বলে উপন্যাসের জনপ্রিয়তা। এই ক্ষেত্রে সৈয়দ হকও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বৈকি!

এই উপন্যাসের জন্য সৈয়দ হক যতটা আলোচিত হয়েছেন তারচেয়ে বেশি হয়েছেন সমালোচিত। সৈয়দ হক তাঁর এই উপন্যাসটিকে ‘এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। উপন্যাসটির পরিমার্জিত ইত্যাদি সংস্করণের ভূমিকায় এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘এই সেদিন নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম সেখানে মুক্তধারার বইমেলায়। মাঝবয়সী বহু মহিলা এসে আমার সঙ্গে আলাপিত হলেন আর ঈষৎ সলজ্জ হয়ে জানালেন তাঁদের কিশোরী বয়সে চুরি করে খেলারাম পড়বার ইতিহাস। এবং তাঁরা প্রায় সবাই বললেন, কই! এখন তো আর তেমন অশ্লীল বলে মনে হয় না খেলারাম-কে! আবার এ রকমও হয়েছে― এখনো― এই যে, মাত্রই কয়েক বছর আগে ঢাকায় ফরাসি দূতাবাসের এক পার্টিতে গেছি― খোলা বাগানে সমাবেশ, কথা বলবার মতো কাউকে না পেয়ে আমি বাগানের এক প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে পানীয়ে চুমুক দিয়ে চলেছি, হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ! বলছে, এই সরে আয়! ওই লোকটা অসভ্য বই লেখে! আলগোছে তখন পেছন ফিরে দেখি― শুভ্রকেশী সত্তরোর্ধ্ব এক মহিলা তাঁরই বয়সী আরেক মহিলাকে আমার থেকে নিরাপদ দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন ওই কথাটি বলে।’

তার মানে উপন্যাসটির জন্য সৈয়দ হককে অনেক বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে। আসলেই কি খেলারাম খেলে যা অশ্লীল? সত্তরের দশকের বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে ‘অবিকশিত’ বাঙালি পাঠকদের কাছে হয়ত উপন্যাসটি অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। এই কালে, অর্থাৎ এই একুশ শতকের পাঠকদের কাছে এটি মোটেই অশ্লীল মনে হবে না। সৈয়দ হক এই উপন্যাসে বাবর আলীর মাধ্যমে যে যৌন পরিস্থিতির নির্মাণ করেছেন তাতে শেষপর্যন্ত মূলত এক ধরনের অপ্রেম আর বিবমিষারই প্রমাণ পাওয়া যায়। উপন্যাসটির নিবিড় পাঠের পর এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বাবর আলীকে কি লম্পট মনে হয়? মোটেই না। বাবর আলী দাঙ্গার শিকার হয়ে এই দেশে আসে। সে তার সহোদরা হাসনুকে দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। সেই স্মৃতি তার পিছু ছাড়ে না। উপন্যাসের শেষে ধর্ষকদের হাত থেকে জাহেদাকে বাঁচাতে চেয়েছে বাবর। সেখানেই তার প্রকৃত পৌরুষের প্রথম ও শেষ পরিচয় পাওয়া যায়। টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপক বাবর আলী খানকে আমরা আপাতদৃষ্টিতে লম্পট হিসেবেই দেখি। সে অবিবাহিত কিন্তু বয়স্ক পুরুষ। কিন্তু খেলারাম খেলে যা কি অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে বাবরের শরীরিক সম্পর্কের ধারাবাহিক কাহিনি? লতিফা, মিসেস নাফিস, বাবলি, জাহেদার মতো নারীর কাছে বাবর আলী খান কেন যায়? কিসের জন্য যায়? শুধু দৈহিক কামনার জন্য যায় না, সেই যাওয়ার পেছনে রয়েছে তার আত্মক্ষরণের সেই ইতিকথা, যা গোটা খেলারাম খেলা যা উপন্যাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে শৈল্পিকভাবে। নারী-শরীরের উত্তাপে নিজেকে শীতল করে করে বেঁচে থাকার সত্যিকারের দহন মিটিয়ে নিতে চায় বাবর। কিন্তু তা সে কতটা পারে? উপন্যাসটির মূল স্রোতটিকে এতটা সার্থকভাবে সৈয়দ হক আড়ালে রেখেছেন যে, অপরিণত অবিকশিত পাঠকের চোখে সেটি ধরা পড়ে না, আড়ালেই থেকে যায়। তাদের কাছে খেলারাম খেলে যা মানে বাবরের যৌন-অভিযান। কিন্তু আসলে তা নয়।

এই উপন্যাসের মূল বক্তব্যটা কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তাফা কামালের একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যাক। খেলারাম খেলে যা নিয়ে তিনি যে প্রবন্ধটি লিখেছেন সৈয়দ হক সেটি সংযুক্ত করেছেন খেলারাম খেলে যা’র পরিমার্জিত ইত্যাদি সংস্করণে। আহমাদ মোস্তাফা কামাল বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে উপন্যাসটি সম্পর্কে যে মূল কথাগুলো বলেছেন তা হচ্ছে এই, ‘...বাবর বস্তুত হাসনুকেই উদ্ধার করেছে। কৈশোরে বোনকে রেখে পালিয়ে আসার ফলে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সীমাহীন গ্লানি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা ও অনুতাপ; এসব ভুলে থাকার জন্য সে বেছে নিয়েছিল প্রতারণা ও লাম্পট্যের পথ, আর নিজের পরস্পরবিরোধী এই দুটো চরিত্র তাকে করে তুলেছিল দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ। কার প্রতি প্রতিশোধ নেবে বাবর তার একটি উত্তর যেন পাওয়া যাচ্ছে এবার। সে আসলে নিজের প্রতিই প্রতিশোধস্পৃহা লালন করে, নিজের সঙ্গেই নিজের নিরন্তর দ্বন্দ্ব তার, নিজের সঙ্গেই যাবতীয় বোঝাপড়া। বেদনাময়, যন্ত্রণাকাতর আর গ্লানিকর সমস্ত ঘটনার জন্য অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই দায়ী করে এসেছে সে বারবার, আর এসব ভুলে থাকার জন্য, জীবনের বর্ণ-গন্ধময় স্বপ্নীল আয়োজনে শরীক হবার জন্য নিজের ভেতরে তৈরি করেছে ভিন্ন আরেকটি চরিত্র― সে মাতাল, লম্পট, কামুক, প্রতারক। বাবর হয়তো পুরোপুরি ‘সুস্থ’ মানুষও নয়। কৈশোর থেকে বয়ে বেড়ানো আত্মপীড়ন, ক্ষরণ, দ্বন্দ্ব ও দহন তাকে পরিণত করেছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক অসহায়-ভাসমান-বীতশ্রদ্ধ মানুষে। এবার আপনিই বলুন পাঠক, উপন্যাসটিকে কি আর স্রেফ একজন কমোত্তেজনায় উন্মাদ লোকের অদ্ভুত কীর্তিকলাপের রসালো বর্ণনা― বা পর্নোগ্রাফি― বলে ভাবার কোনো অবকাশ থাকে?”

না, থাকে না। খেলারাম খেলে যা’র একজন পাঠক হিসেবে আমি অগ্রজ আহমাদ মোস্তাফা কামালের অভিমতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। বাবর সত্যিকারার্থেই বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য জীবন্ত চরিত্র, সবচেয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল, দার্শনিক ও দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ ট্রাজিক এক চরিত্র। খেলারাম খেলে যা বাংলা সাহিত্যের অসামান্য এক আধুনিক উপন্যাসের নাম। অথচ এই আধুনিক উপন্যাসটিকে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন! তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে, বিদ্যাপ্রকাশ থেকে। সেখানে খেলারাম খেলে যা ছিল। কিন্তু উনিশ বছর পর, ২০০৯ সালে অনন্যা থেকে তাঁর যে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস প্রকাশিত হয় সেটিতে খেলারাম খেলে যা নেই। কেন নেই? কেন তিনি শ্রেষ্ঠ তালিকা থেকে উপন্যাসটিকে বাদ দিলেন? উপন্যাসটি অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত সেজন্যে? উপন্যাস হিসেবে পরবর্তীকালে এটি তাঁর কাছে দুর্বল মনে হয়েছে, সেজন্যে? আমরা ঠিক জানি না। সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে নেই। থাকলে এই প্রশ্ন তাকে করা যেত। কে জানে, হয়ত এমনও হতে পারে, এই উপন্যাসকে তিনি একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জায়গায় রাখবার মনস্থির করেছেন। অর্থাৎ এটি আলাদা গ্রন্থ হিসেবে থাকবে, সমগ্রেও যেতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো সংকলনে থাকবে না। যদি এমনটা হয়, তাহলে বলা যায়, উপন্যাসটিকে লেখক নিজেও গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছেন।

২০১৬ সালের আজকের দিনে প্রয়াত হন সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ আমাদের সম্পদ, উত্তরকালের সাহিত্যিকদের প্রেরণা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

একুশে বইমেলা ২০১৮